বিকাশ দাস
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরে নিজের জন্য এককাপ চা তৈরি করছিলাম। সেই সময় এক অধ্যাপক সহকর্মী ফোন করে জানালেন পহলগামের ঘটনার কথা। তারপর থেকে আমার মোবাইল ফোনের ঘণ্টী অবিরাম বেজেই চলেছে। এক বছর আগে যখন কাশ্মীর কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক পদে যোগ দেওয়ার নিয়োগপত্র পেয়েছিলাম, তখন শুভাকাঙ্ক্ষী মানুষজন একটু অমত করলেও একপ্রকার সেসব কথায় কান না দিয়েই ব্যাগপত্র গুছিয়ে কাশ্মীর এসেছি। আইআইটি গুয়াহাটিতে পিএইচডি শেষ করার এক মাসের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার সুযোগ। চোখে আমার অনেক রঙিন স্বপ্ন। কালকের ঘটনার পরে সেই স্বপ্ন ফিকে হয়ে যায়নি ঠিকই, কিন্তু একটা ঝটকা অবশ্যই লেগেছে।
আমি কাশ্মীরে আসার পর গত এক বছরে এটা তৃতীয় ঘটনা। অক্টোবরে গান্দেরবাল জেলার শ্রীনগর-লেহ জাতীয় মহাসড়কের একটি সুড়ঙ্গ নির্মাণ স্থানে শ্রমিকদের তাঁবুতে সন্ত্রাসবাদীদের হামলায় ৭ জন নিহত হয়েছিলেন। নভেম্বরে বিখ্যাত লাল চকে সাপ্তাহিক রবিবারের হাটে গ্রেনেড হামলায় বারোজন সাধারণ নাগরিক আহত হয়েছিলেন। কিন্তু মঙ্গলবারের পহলগাম হামলার নৃশংসতা এবং ভয়াবহতা কয়েক শতগুণ বেশি।
আমার কাশ্মীরি সহকর্মীরা জীবনে কাশ্মীরে সন্ত্রাসবাদী ঘটনার অনেক কালো অধ্যায় দেখেছেন কিন্তু পর্যটকদের ওপর এই ধরনের হামলা দেখে তাঁরাও একপ্রকার হতভম্ব এবং স্তম্ভিত। তাঁরা বলছিলেন, বিগত কুড়ি-পঁচিশ বছরে এমন ঘটনার কথা তাঁরা মনে করতে পারছেন না। কয়েকদিন আগের হড়পা এবং পাহাড়ে ধসের কারণে শ্রীনগর-জম্মু মহাসড়ক একপ্রকার বিচ্ছিন্ন। শ্রীনগর থেকে দেশের অন্য প্রান্তে ট্রেন চালু হওয়ার কথা গত কয়েক মাস থেকে আকাশে ভাসলেও সেটা আজও চালু হয়নি। এই ঘটনার পরে নিরাপত্তার খাতিরে ট্রেন চালু হওয়া আরও বিলম্বিত হবে। শ্রীনগর বিমানবন্দরের বাইরে পর্যটকদের ভিড় বাড়ছেই। পর্যটকরা ফিরতে মরিয়া।
এই দৃশ্য কাশ্মীরের অর্থনীতি যা মূলত পর্যটনশিল্প কেন্দ্রিক তার ওপর অদূরভবিষ্যতে গভীর প্রভাব ফেলবে। যা দেখে কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী দুঃখ এবং অনুশোচনা প্রকাশ করেছেন। সাধারণ মানুষ প্রতিবাদে পথে নেমেছেন। শ্রীনগরের দোকানপাট, ব্যবসা, গাড়ি, বাস, সহ, স্কুল, কলেজ এবং বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আজ সম্পূর্ণ বন্ধ ছিল। চারিদিকে এক থমথমে চাপা পরিবেশ। ছাত্রছাত্রীরা এই বর্বরোচিত ঘটনার প্রতিবাদে এক মৌনমিছিলে অংশগ্রহণ করে।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা বিশাল সংখ্যক ছাত্রছাত্রী ওডিশা, কেরল, ঝাড়খণ্ড, অসম এবং পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা। বাড়ি থেকে হাজার মাইল দূরে এঁরা দুই চোখে অনেক স্বপ্ন নিয়ে কাশ্মীর কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য এসেছে। যাদের অনেকের মনেই আজ আমি এক অজানা আতঙ্কের ছায়া দেখেছি। এই নবীন প্রাণগুলির শিক্ষক এবং অভিভাবক হিসাবে আমাদের দায়িত্ব শুধু ক্লাসরুমের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। নিজেদের সীমাবদ্ধতা সরিয়ে রেখে আমারা চেষ্টা করছি এদের মনে সাহস জোগাতে, এদের ভরসা দিতে। বুধবার বিকেলে শুনলাম যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জরুরি মিটিংয়ে স্থির হয়েছে আগামীকাল থেকে হয়তো আগামী ছয় সপ্তাহের জন্য শুধু ছাত্রছাত্রীদের ছুটি দিয়ে দেওয়া হবে এবং পঠনপাঠন আবার করোনা অতিমারির মতো অনলাইনে হবে। করোনা অতিমারি সময়ের সঙ্গে দুই-তিন বছরে শেষ হয়ে গিয়েছে কিন্তু তারপরেও সাধারণ ক্লাসরুম শিক্ষা ব্যবস্থায় ফিরতে সময় লেগেছে অনেক। কিন্তু এই অনিশ্চয়তা আর ধর্মীয় সন্ত্রাসের মহামারি কবে শেষ হবে? উত্তরটা আজ খুবই আবছা মনে হচ্ছে।
(লেখক শ্রীনগরের বাসিন্দা। কাশ্মীর কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক)