বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব শারদোৎসব। আনন্দে মাতোয়ারা গোটা বাংলা। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মহালয়ার আগের দিনই পুজোর উদ্বোধন শুরু করেন। বস্তুত সেদিন থেকেই প্রতিমা দেখা শুরু। পুজো শেষে কার্নিভাল হবে কলকাতার রেড রোডে। গত দু’বছর ধরে কার্নিভাল ছড়িয়ে পড়েছে জেলাগুলোতেও। মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যের ৪৫ হাজার পুজো কমিটিকে অনুদান দিয়েছেন ১ লক্ষ ১০ হাজার টাকা করে। এতে রাজ্যের খরচ হয়েছে প্রায় ৫০০ কোটি।
দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে রাজ্যের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ায় বলে সরকারের দাবি। অনেকে এসময়ে সারা বছরের রোজগার সেরে নেন। যাতে অন্তত কয়েক লক্ষ মানুষের বছরভর খাওয়া-পরার ব্যবস্থা হয়। এবার ২২ সেপ্টেম্বর রাতে মেঘভাঙা বৃষ্টিতে কলকাতায় পুজোর সেই রোজগার কিছুটা বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে সন্দেহ নেই। বিশ্বের যে প্রান্তেই থাকুন না কেন, দুর্গোৎসবে মেতে ওঠেন বাঙালি। তবে এবার কোথাও কোথাও বিষাদের সুরও আছে।
আনন্দযজ্ঞে রাজ্যের সব পরিবার কি শামিল হতে পারবে? ক’দিন আগে পাঁচ দশকের মধ্যে রেকর্ড বৃষ্টিতে জলমগ্ন কলকাতায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে ১১টি প্রাণ চলে গেল। আনন্দ করতে পারবে কি তাঁদের পরিবারগুলি? মুখ্যমন্ত্রী মৃতদের প্রত্যেকের পরিবারকে ২ লক্ষ করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ঘোষণা করেছেন। এছাড়া পরিবারগুলিকে পাঁচ লক্ষ টাকা করে দেবে সিইএসসি।
প্রশ্ন হল, ক্ষতিপূরণ আর চাকরিই কি সব? মৃত্যুর দায় কার, সিইএসসি নাকি কলকাতা পুরসভার? পরস্পরকে দোষারোপ চলছে। কিন্তু মহানগরীর নিকাশি সমস্যার সমাধান হয় না। মেয়র পারিষদ (নিকাশি) তারক সিংহ নির্লজ্জের মতো বলতে পারেন, ‘জমা জলে নামা মানেই তো আত্মহত্যা। মানুষ নামে কেন?’ মধ্যরাতের ওই বৃষ্টিতে কলেজ স্ট্রিটের বইপাড়ায় নষ্ট হয়েছে কয়েক কোটি টাকার বই। ফুটপাথের বই ব্যবসায়ীরা সর্বহারা। কেমন কাটবে তাঁদের পুজো?
সম্প্রতি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঝিলে ইংরেজি অনার্সের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী অনামিকা মণ্ডলের রহস্যমৃত্যু ঘটল। পারবে তাঁর পরিবার পুজোয় প্রতিমা দেখার জন্য বেরোতে? আবার মালদার একটি হোটেলে আরজি করের চতুর্থ বর্ষের যে ছাত্রীর রহস্যমৃত্যু ঘটল, সেই অনিন্দিতা বসুর বাবা-মা পারবেন পুজো উপভোগ করতে? আরজি কর বললে উঠবে তরুণী চিকিৎসককে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনা।
এক বছর আগের সেই ঘটনা আজও রহস্যাবৃত। হাসপাতালের চারতলায় গভীর রাতে তাঁদের মেয়েকে ধর্ষণ ও হত্যায় মাত্র একজনই জড়িত, বিশ্বাস করতে পারেন না ওই নির্যাতিতার মা-বাবা। মৃত্যুর কয়েক বছর আগে থেকে বাড়িতে দুর্গাপুজো শুরু করেছিলেন অভয়া। জীবদ্দশায় আর কখনও তাঁর বাবা-মা কি দুর্গাপুজোয় শামিল হতে পারবেন?
আরজি করের নির্যাতিতার পরিবারের মতোই চরম মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে পুজো কাটবে কসবার সাউথ ক্যালকাটা ল’ কলেজ ধর্ষিতা ছাত্রীর পরিবারের। যাঁকে গণধর্ষণ করা হয় কলেজের ইউনিয়ন রুমে। শিক্ষাঙ্গনে নারী নির্যাতন নিয়ে কত হইচই! রাজ্য সরকার অপরাজিতা বিল নিয়ে এল। কিন্তু শিক্ষাঙ্গনে গণধর্ষণ বন্ধ হল না।
পুজোয় মনে এতটুকু আনন্দ নেই এসএসসি’র ২০১৬ সালের প্যানেলের চাকরিহারা শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে বাতিল ২৫,৭৫৩ জনের চাকরি। যোগ্য শিক্ষকরা ডিসেম্বর পর্যন্ত চাকরিতে আছেন। নতুন করে পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগও পেয়েছেন। কিন্তু শিক্ষাকর্মী এবং অযোগ্য চিহ্নিত শিক্ষকদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। পরিবারের সকলের জন্য পুজোর জামাকাপড় কেনা দূরের কথা, দু’বেলা দু’মুঠো ভাত জোটানোই এখন তাঁদের মাথাব্যথা।
তবু বাঙালির দুর্গাপুজোর আকর্ষণ আলাদা। উৎসব উপলক্ষ্যে সর্বত্র কঠোর নিরাপত্তার ব্যবস্থা। পুজোর চারদিন যেন নির্বিঘ্নে কাটে, মুর্শিদাবাদ-মালদা সহ গোটা রাজ্যেই যেন সম্প্রীতির পরিবেশ বজায় থাকে, এটাই এখন একমাত্র প্রার্থনা।