মৈনাক কুন্ডা
আলিপুরদুয়ার কিছুদিন হল সরগরম। প্রধানমন্ত্রী আলিপুরদুয়ার প্যারেড গ্রাউন্ডে এক সভা করে গেলেন। ঝকঝকে তাঁবু, পেল্লায় সব নির্মাণ, বিভিন্ন কংক্রিটের ব্লক ইত্যাদি দিয়ে এমন একটা আবহ তৈরি হয়েছিল যা সহজে দেখা যায় না। বিশেষত এই জলা-জঙ্গলের দেশ আলিপুরদুয়ারের বাসিন্দারা এমন সুযোগ সচরাচর পান না। আয়োজনটি দেখে মনে পড়ে যায় প্রাচীন ভারতের রাজসূয় যজ্ঞের দৃশ্যপট। অপূর্ব শোভাযাত্রা, আলোকসজ্জায় ঝলমলে বিশাল প্যান্ডেল, দূরদূরান্ত থেকে আগত অতিথিদের আনাগোনা- সব মিলিয়ে যেন এক রাজকীয় আবহ। সাজসজ্জা, নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রতিটি দিকেই ছিল পরিকল্পনার ছাপ। সেই সভা, সেই মঞ্চ, সেই হেলিপ্যাড প্যারেড গ্রাউন্ডকে ভাগাড়ের চেয়েও খারাপ অবস্থায় ঠেলে দিয়েছে। প্যারেড গ্রাউন্ডের মতো শহরের মধ্যে সুবিশাল মাঠ উত্তরবঙ্গে দ্বিতীয়টি আছে বলে জানা নেই।
স্বচ্ছ ভারত মিশনের বুলি আওড়ানো প্রধানমন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে এখন উপহাসের হাসি হাসছে মাঠটি। প্রধানমন্ত্রী ২০১৪-র ২ অক্টোবর স্বচ্ছ ভারত মিশন প্রকল্প চালু করেছিলেন। ২০১৯-এর মধ্যে ভারতবর্ষকে ‘স্বচ্ছ দেশ’ হিসাবে গড়ে তোলার উদ্দেশ্য। যেহেতু লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২০১৯ তাই হয়তো ২০২৫-এ মাঠ অস্বচ্ছ করায় দোষের কিছু দেখছেন না নেতা, আমলারা। কিংবা তাঁরা হয়তো ভেবেছেন, দেশ তো এখন পরিষ্কার, তাই এইটুকু নোংরা করা যেতেই পারে! অথবা প্রধানমন্ত্রী দর্শন-এর তুলনায় এ আর এমন কী!
যে মাঠ আলিপুরদুয়ারের গর্ব, তার ওপর যথেচ্ছ অবিচার দীর্ঘদিন থেকে নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর আগে মাঠের দফারফা করে বারবার মুখ্যমন্ত্রীর সভা হয়েছে। যখন রাজনৈতিক প্রতিপত্তির চরমে, সভা করেছেন বাম নেতারা। এই তো কিছুদিন আগের কথা, প্রশাসনিক সভা করে গেলেন মুখ্যমন্ত্রী। তখনও মাঠে ম্যারাপ বাঁধা হয়েছে। বাইরে থেকে আনা ট্রাক লোহার সরঞ্জাম দিয়ে প্যান্ডেল তৈরি হয়েছে। আবার, মুখ্যমন্ত্রীর দলের লোকেদের পরিকল্পনাতেই মাঠের এক কোনায় মুক্তমঞ্চ জাতীয় একটা কংক্রিটের নির্মাণ তৈরি করে ফেলা হল। তখন অবশ্য আলিপুরদুয়ার বিষয়টা নজরে আনেনি। প্রতিবাদ সভাও হয়নি। জেলা শাসকের বাংলোর ঠিক উলটোদিকে মাঠে, একটি ঘর তৈরি হয়ে পড়ে আছে। ওটা নাকি সৌন্দর্যায়নের জন্য। বর্তমানে কমবয়সি ছেলেমেয়েদের নেশার আড্ডা বসে সেখানে। প্রতি বছর ডুয়ার্স উৎসব এবং হরেক মেলাকে কেন্দ্র করে মাঠের উপর অত্যাচার তো আমাদের গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে। মাঠের একধারে যে হেলিপ্যাড তৈরি করা হয়েছে, ওটা নাকি চিরস্থায়ী হয়ে গিয়েছে। এই ফ্ল্যাশব্যাক সঙ্গী করেই প্রধানমন্ত্রীর সভা। কথায় বলে, ‘স্যাকরার দশ ঘা, আর কামারের এক ঘা’। প্রধানমন্ত্রীর সভা প্যারেড গ্রাউন্ডে সেই ঘা দিয়েছে। এমন ঘা পড়েছে যে, প্যারেড গ্রাউন্ড কোমায় চলে গিয়েছে।
দল বদলাবে, নেতা বদলাবে, নেতারা দল পালটাবেন, কিন্তু প্যারেড গ্রাউন্ডটা থাকবে। আলিপুরদুয়ারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, প্যারেড গ্রাউন্ডকে জেলার মানুষ কী হিসেবে দেখতে চান, সম্পদ, নাকি বিপদ? যদি সম্পদ হিসেবে দেখার ইচ্ছে থাকে তাহলে কিছু পদক্ষেপ করতেই হবে। প্রথমত, প্যারেড গ্রাউন্ডকে পুরোনো অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে, দ্বিতীয়ত, একটা নিয়ম চালু করতে হবে। পুরসভা, প্রশাসন, পুলিশ, জেলা পরিষদ, বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, রাজনৈতিক দল মিলে তা তৈরি করবে। সেটা সবাইকে মেনে চলতে হবে। তৃতীয়ত, যারা বাণিজ্যিক, রাজনৈতিক কারণে মাঠ ব্যবহার করবেন তাঁদের টাকা দিয়ে মাঠ ভাড়া নিতে হবে। সেই টাকা মাঠের উন্নয়নেই কাজে লাগাতে হবে। তবে যে কথাটা না বললেই নয়, দূষণ শুধু ইট-বালি-পাথরেই হয় না। গোটা প্যারেড গ্রাউন্ডে সন্ধ্যার সঙ্গে দূষণ আসে নেশার হাত ধরে অশালীনতায়। কে বন্ধ করবে? দায় কে নেবে? সাধারণ মানুষ সচেতন না হলে, দায়িত্ববান না হলে কিছুই হবার নয়। প্যারেড গ্রাউন্ডটা যদি আলিপুরদুয়ারে না হয়ে কলকাতায় হত তাহলে কি কেউ সাহস দেখাতেন মাঠের সর্বনাশ করার? কলকাতায় পান থেকে চুন খসলে রে-রে পড়ে যায়, গাছ কাটা পড়লে গান হয় পথের ধারে, মাঠ খুঁড়লে মিছিল হয় রাজপথে। প্রশাসন, পুলিশের তৎপরতা বাড়ে, বিধানসভায় আলোচনা হয়। কিন্তু রাজধানী শহর থেকে সাতশো কিলোমিটার দূরের শহরের মাঠের কান্না কলকাতার বাবুদের ঠান্ডা ঘরে পৌঁছায় না, দিল্লি তো বহুদূর।
আসলে উত্তরবঙ্গের সহিষ্ণুতাকে দুর্বলতা ধরে নেওয়া হয়েছে। কলকাতার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে সভার পর নেতা-কর্মীদের ঠোঙা কুড়োনোর ছবি পরিবেশ সচেতনতা নিয়ে সাধারণ মনে ভরসা জোগায়, কিন্তু আলিপুরদুয়ার প্যারেড গ্রাউন্ডের দুর্দশার ছবি আতঙ্ক তৈরি করে না।
(লেখক- প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক, আলিপুরদুয়ারের বাসিন্দা)