- চিরদীপা বিশ্বাস
‘নিয়ে নিলাম টাটকা হিমসাগর আম… বিয়ের পর প্রথম জামাইষষ্ঠী, বুঝতেই পারছেন বন্ধুরা, মেয়ে-জামাইয়ের খাতিরদারিতে কোনও কমতি চলবে না’- ব্যস্ত ভরা বাজারে ‘জেন জি’ শাশুড়ির এমনতর জামাইষষ্ঠী স্পেশাল ভ্লগিং দেখে চক্ষু ছানাবড়া হওয়ার জোগাড়। এই মডার্ন আয়োজন মনে করিয়ে দিল ছোট্টবেলার নিজের দিদিমার বাড়ির জামাইষষ্ঠীর কথা। সে যেন এক বিশাল পারিবারিক রি-ইউনিয়ন। ভূরিভোজ, নতুন জামার গন্ধ, বায়নায় পাওয়া কাঁঠাল পাতা, সিঁদুর লাগানো আম, কলা- সবমিলিয়ে জমজমাট একটা দিন কাটত প্রতিটা বছর।
দিদার কাছে মা ষষ্ঠীর ব্রতকথা শোনা, বিড়ালের গল্প এবং প্রতিবারের ‘এই আজকে কিন্তু বিড়ালের গায়ে একদম হাত দিবি না’ সতর্কবাণী শোনা সত্ত্বেও পরমুহূর্তেই যে কোনও একটা বিড়াল খুঁজে তাকে উত্ত্যক্ত করার জন্য ব্যস্ত হয়ে ওঠা- আজকালের রিল বা ভিডিওতে এসবের দেখা মেলা কিঞ্চিৎ দুষ্কর।
মাত্র বছর কয়েকের মধ্যেই চালচিত্রের এতটা বদল ঘটে গেছে যে এই আন্তরিকতাগুলো, নিয়মরীতির চোখরাঙানি সত্ত্বেও ভালোবাসার বাঁধনগুলোর অভাব বড্ড বেশি করে অনুভূত হয়। দিদিমাহীন সেই বাড়িটাতে এখন আর জামাইষষ্ঠীর আড়ম্বর নেই, নেই হলুদ সুতো বা ষাটের জল। অন্যদিকে হোয়াটসঅ্যাপ বা ফেসবুকের কল্যাণে নবীন প্রজন্মের জামাইষষ্ঠীর যে ঝলক উঠে আসে, ছোটবেলার সেই দিনটার সঙ্গে তার অমিল অনেকটাই। ইউটিউব খুললেই ‘জামাইষষ্ঠী স্পেশাল থালি’ বা ‘ষষ্ঠীর অফার’ জাতীয় শর্টস, ভিডিওতে ভরে যায় ফিড। তার কোনওটা হদিস দেয় ‘বেস্ট কম্বো থালি’র তো কোনওটা আবার সকল উপকরণ সহযোগে কোনও এক বাংলোয় পূর্ণাঙ্গ আয়োজনের একশো শতাংশ ভরসার।
ফার্স্ট-ফরওয়ার্ড এই যুগে, সময় সকলের হাতেই বড্ড স্বল্প। মেয়ে, জামাইয়ের অফিসের চাপ, অতএব ভিডিও কল আর শাশুড়ির অর্ডার করা জোম্যাটোর ফুডই কোনও কোনও জামাইষষ্ঠী উদযাপনের সঙ্গী হয়। অন্যদিকে, অনেক শাশুড়িমা-ই পুজোআচ্চা করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা হেঁশেল ঠেলে, জামাইবরণের ঝুঁকি আর নেন না। তার চেয়ে বাড়ির বাইরে বন্দোবস্ত করেন জামাইয়ের জন্য, এই স্পেশাল দিনে কোনও এক ট্রেন্ডিং বাঙালি রেস্তোরাঁয়। বাবাজীবনও জোড়া ইলিশ, মিষ্টির হাঁড়ির তথাকথিত ছক ভেঙে আধুনিক উপহারে ভরিয়ে তোলেন শাশুড়িমাতার ওয়ার্ডরোব।
এভাবেই বাঙালির চিরকালীন ঐতিহ্যের সঙ্গে ধীরে ধীরে আধুনিকতার মিশেল ঘটে চলেছে। বর্তমানে মহিলা মহলও খুব বেশি আবেগে না ভেসে প্র্যাকটিকালি বিষয়টিকে দেখে নিজেরাই হয়তো মায়েদের বলে, কী দরকার অত ধকল নেওয়ার, চলো একটা দিন বাইরে কাটিয়ে আসি বরং। এর পাশাপাশি ‘বৌমাষষ্ঠী’র কনসেপ্টও আজকাল জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এতেও অবদান খানিকটা সমাজমাধ্যমের তো বটেই। সেলেব্রিটিদের ষষ্ঠী সেলিব্রেশন, তাদের আয়োজন ইত্যাদি নিত্যনতুন আইডিয়া আজকের চিন্তাচেতনাকে প্রভাবিত করে ভীষণরকম।
নিঃসন্দেহে একুশ শতকের উদারমনা নারীরা এই জামাইষষ্ঠীকে পিতৃতান্ত্রিক সমাজের প্রতিমূর্তি ঠাওরাতেই পারেন। তাই স্টিরিওটাইপ ভেঙে ‘বৌমারাও কম কীসে’ ধারণার বিপুল জনপ্রিয়তা আজকের যুগে।
সময়ের অভাবে রেডিমেড হাতপাখা, হলুদ সুতো দিয়েই আজকাল কাজ চলে। গাছ থেকে আনা তালপাতার তৈরি পাখার বাতাস আর হলুদ বাটা ও সর্ষের তেলে মাখানো সুতোর হলদে রং-এর স্পর্শ আর ক’জন পায় এখন! খুব পুরোনো তো নয়, যখন ষষ্ঠী শুধুই কনটেন্ট ছিল না। ছিল মেয়েদের ঘরে ফেরার এক উৎসব। অনুষ্ঠান একদিনের হলেও দিন চার-পাঁচেক আগে থেকেই চলত তার তোড়জোড়।
আজকের কনটেন্ট নির্ভর জীবনযাপন দেখে তাই কোথাও গিয়ে যেন মনে হয়, উৎসবের প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলছি না তো আমরা! সেই আন্তরিকতা, ঘরের মেয়ের ঘরে ফেরার উচ্ছ্বাস, ঐতিহ্যের ছোঁয়া, বাঙালিয়ানা সত্যি ধরে রাখতে পারছি কি? দ্রুততার এই যুগে, প্র্যাকটিকালি ভাবতে ভাবতে এসব ভুলে যাচ্ছি না তো? গুটিকয়েক যে উদাহরণ পুরোনো বাঙালিয়ানা, উৎসবের প্রাসঙ্গিকতা ধরে রেখেছে সেখানে স্পষ্টতই বয়োজ্যেষ্ঠরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছেন আজও। ষাটের জল, পাখার বাতাস, তেল-হলুদ মাখানো সুতো- প্রতিটারই একটা নির্দিষ্ট গুণাগুণ রয়েছে। বিড়ালের অনুষঙ্গ শুধুই একটা গল্প তো নয়, পশুপ্রেমের প্রথম পাঠ ওর থেকেই পাওয়া।
ছোট থেকে আবেগ, আন্তরিকতা আঁকড়ে বড় হওয়ার পর মহানগরের ব্যস্ততাময় জীবন বাস্তব চিনিয়ে চলেছে অবিরাম। ঐতিহ্য, প্রাচীনতা সেখানে ঠোকর খায় আধুনিক নগরজীবনের গতির সঙ্গে। বাংলার লোকাচার পালনেও তাই সামান্য হেরফের থাকা অস্বাভাবিক বা দোষের নয়। কল্লোলিনীর ব্যস্ততাময় নগরজীবনে নব্য জামাইবরণের প্রচলন একটু বেশি পপুলার, যা এখনও উত্তরে সেভাবে থাবা বসাতে পারেনি।
উত্তরবঙ্গের ঢিমেতালে চলা জনজীবন কিন্তু আজও খানিকটা সেই প্রথাগত ঐতিহ্য মেনে চলারই পক্ষপাতী। কোচবিহার শহরের কোনও এক উমা তাই দিব্যি কাজ গুছিয়ে পতিদেব, ছেলেপিলেদের সঙ্গী করে দিনহাটা বা মাথাভাঙ্গায় নিজের বাড়িতে দুটো দিন কাটিয়ে আসার সুযোগ পেয়ে যায় অনায়াসে। মেয়ে, জামাই, নাতি-নাতনিদের মাথায় ষাটের জল, পাখার বাতাস দিয়ে তৃপ্ত হন বয়স্কা মা-ও। যেখানে কর্পোরেটের চোখরাঙানির ভয়ে কলকাতানিবাসী কোনও কন্যা হয়তো দূরবর্তী বাপের বাড়ির বদলে কাছাকাছি কোনও রেস্তোরাঁর স্পেশাল ভোজের থালি দিয়েই নমো-নমো করে কাজের সমাপন ঘটাতে বাধ্য হয়, বাবাজীবনও শাশুড়ি মায়ের হাতের ছোঁয়া রান্নার স্বাদ গ্রহণে বঞ্চিত থাকে, সেখানে হয়তো উত্তরবাংলা চুটিয়ে জামাইষষ্ঠীর রি-ইউনিয়নে মেতে ওঠে হইহই করে। মহানগরীর ‘৫৯৯ টাকার বাঙালি থালি’র মাটন কষা, ইলিশ, চিংড়ির কম্বো পাতে দিতে না পারলেও, বিলের রুই মাছের মাথা দিয়ে ডাল, কচি মুরগির ঝোল, ঘরেপাতা দই আর আন্তরিকতা সহযোগে এক বিশাল আত্মিক সংযোগ গড়ে তোলে উত্তরের কোনও গ্রামবাংলার জামাইষষ্ঠীর অনুষ্ঠান।
অবশ্যই এক্ষেত্রে খানিক অন্যরকম উদাহরণ থাকতেই পারে। তবে, এসব মিল-অমিলের ঊর্ধ্বে থাকে একাগ্রচিত্তে সন্তানের মঙ্গলকামনা। বদলাতে থাকা এই সময়ে ঐতিহ্যের সংরক্ষণ একমাত্র তখনই সম্ভব যখন প্রাচীনতা এবং আধুনিকতার মিশেল ঘটে সঠিকভাবে। শুধুই ট্রেন্ডে চলা কম্বো থালির ভিডিও নয়, বরং তথ্যবহুল সৃজনশীল প্রচেষ্টার মাধ্যমেও বাংলা ও বাঙালির কৃষ্টি নবপ্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব। তাই প্রাচীনতাকে ভুরু কুঁচকে ব্যাকডেটেড না বলে, আবার হালফিলের দেখনদারি সর্বস্ব মডার্ন জামাইষষ্ঠীকে খোঁটা না দিয়ে, প্রয়োজন দুয়ের মধ্যে একটা সঠিক সামঞ্জস্য তৈরি করার। তবেই তো বাংলা ও বাঙালির নিজস্বতা অটুট থাকবে, আর বাঙালি বলতে পারবে ‘বাংলা বুকের ভিতরে, বাংলা ভুলি কী করে?’
(লেখক কোচবিহারের মেয়ে। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের পডুয়া)