- সব্যসাচী ঘোষ
উত্তরবঙ্গ এক আশ্চর্য সংগ্রহশালা হতেই পারত। কিন্তু তা হয়নি আদৌ। তথ্য, অনুসন্ধান ও সংগ্রহ; সাগ্রহে পাশাপাশি এই তিন শব্দকে নিয়ে চললে উত্তরবঙ্গের মাঠে ময়দানে যা পাওয়া যায় তা আবেগ বিবর্জিতভাবে ভাবলেও দেশের অনেক স্থান অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।
এই যেমন উত্তরের জল, হাওয়া নিয়ে এক বই। যার নাম ‘বাহারিস্তান-এ-গায়েবি’। লেখক মির্জা নাথান, পারসি ভাষায় রচিত বইটি উত্তরের প্রথম দুই মলাটে বন্দি আকর গ্রন্থ হতেই পারত। ১৭ শতকের জাহাঙ্গিরের আগ্রাসী মোগল সেনা উত্তরবঙ্গ, অসমে ঢুকে পড়েছিল। পেছন পেছন এসেছিল বেশ কিছু অসামরিক লোকজনও। কেউ দিল্লিতে এলাকার তথ্য রিপোর্ট করবেন, কেউ করবেন জরিপ, কেউ আবার সম্পদ পাঠাবার সহজ পরিকল্পনা করবেন। মোগল সাম্রাজ্যের এমনই অসামরিক কাজে এই এলাকায় আসেন মির্জা নাথান। তাঁর এলাকা ঘুরে যে বর্ণনা তাই এই বই-এর উপজীব্য। দিল্লি থেকে এত পুবের দেশে বহু এলাকা ঘুরে পৌঁছে প্রথম যে কারণে তিনি অবাক হয়ে যান তা হল এই অঞ্চলের মাঠঘাট কখনও পাংশু হয় না। গোটা দেশে শুষ্ক কালে যেমন সব কিছু শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায় তখনও এই এলাকার মাটি আর্দ্রতা হারায় না। সবুজ মাঠ হলদেটে হয় না তাই। সেই কারণেই তিনি বই-এর নামে লেখেন বাহারিস্তান। অর্থাৎ চির সবুজের দেশ। কিন্তু সেই বই কোথায়? আমরা কি তা আমাদের কাছে রাখতে পেরেছি। সেই বই যত্নে ছাপিয়ে নিজেদের মালিকানায় রেখে দিয়েছে গৌহাটির কটন ইউনিভার্সিটি।
এই যে উত্তাল হল বাংলাদেশ। রক্ত ঝরল ছাত্রদের। কোটা আন্দোলনের বাইরেও একটা তীব্র সরকার ও ভারত বিরোধী ক্ষোভ। এসব দেখে ভয় পাই, কারা ওদেশের যুবসমাজের মজ্জায় ভারতবিদ্বেষ প্রোথিত করল? বিশ্বকাপ ফাইনালে ভারত হারলে আনন্দ করতে হবে, শেখাল কারা? ওরা তো না হয় ভুল বুঝেছে, কিন্তু আমরা কি ঠিকটা তুলে ধরতে পেরেছি। বড় মঞ্চ থেকে জানাতে পেরেছি যে ডুয়ার্সের জলপাইগুড়ির মেটেলি চা বাগানের মূর্তি ডিভিশনের প্রকাণ্ড মাঠে ভারতীয় সেনার উদ্যোগে মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং শিবিরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সবথেকে প্রথিতযশা সন্তান শেখ কামাল প্রশিক্ষণ নিয়ে গিয়েছেন। আজ সেই মাঠে চা বাগান লাগিয়ে ইতিহাস ঢেকে ফেলা হয়ে গিয়েছে। আমরা সেখানে দুই দেশের একটা সৌহার্দ্য স্মারকটুকুও বানাতে পারিনি।
জয়ন্তীর ১৯৯৩ সালের বন্যায় যে ব্রিজটি ভেঙে পড়েছিল তার ওপর বালির স্তর ক্রমশ বাড়ছে। কিন্তু জেনে নিতে হবে যে ওই একই সময়ে ১৯১৫ থেকে ১৯২৫-এর মধ্যে ওই একরকমের অনেকগুলো সেতু তৈরি করেছিল ব্রিটিশরা। যার মধ্যে তিস্তাবাজারের তিস্তার ওপরেও একই ধরনের সেতু ছিল। সে সব হারালেও লুকসান-নাগরাকাটা বাজারের কাছে কুজি ডায়না নদীর ওপর সেই অবিকল সেতু আজও দাঁড়িয়ে আছে। মাঝে একটু বেঁকে গেছে বলে বড় গাড়ি আর যেতে পারে না ঠিকই কিন্তু বাইক, টোটো পারাপার আজও চলছে। কিন্তু এই সেতু যে মহার্ঘ্য তা আজও উপলব্ধি হয়নি আমাদের।
- সমরেশ মজুমদার নেই কিন্তু গয়েরকাটা আছে। স্বর্গ ছেঁড়া আসলে যে গয়েরকাটা চা বাগান তাও সর্বজনবিদিত। কিন্তু তারপরেও সমরেশ মজুমদারের সেই চা বাগান কর্তৃপক্ষ তার কোয়ার্টারকে আলাদা কোনও মর্যাদা দেয়নি। গয়েরকাটা বাজারের কিছু মানুষ সেই কোয়ার্টারকে সংগ্রহশালা বানাবার দাবি জানিয়ে চলেছেন। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বছর সাতেক আগে মালবাজার শহরের এক প্রকাণ্ড পরিত্যক্ত রেল কোয়ার্টারের সামনে থম মেরে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন। পাশে স্থানীয় যিনি ভ্রমণসঙ্গী তাঁকে আঙুল তুলে দেখালেন এই বাড়িটাতেই আমার শৈশবের অনেকটা, কান্না কথা রোধ করে। এমনভাবে দোমোহনিতেও তাঁর শৈশবের অনেকটা। রেলের গঞ্জ দোমোহনিকে নিয়ে তাঁর কতই না ভূতের গল্প। কোচবিহার বাসস্ট্যান্ডে নেমে রাজবাড়ির দিকে সামান্য এগিয়ে বাঁদিকের গলির যে বাড়িতে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কারটা রাখা আছে, সে বাড়ির নিকটবর্তী অনেকে এখন অমিয়ভূষণ মজুমদারের নামটা ভুলতে বসেছেন। রাজনগরের গ্রামীণ এলাকার আব্বাসউদ্দিনকে নিয়ে এখনও কোনও উল্লেখযোগ্য ইউটিউব ব্লগও চোখে পড়েনি। মেটেলি বাজারের কাঠের যে বাড়িটায় বসে তরুণ মজুমদার ‘পলাতক’ ছবির স্ক্রিপ্ট লিখেছিলেন সেই এলাকার কোনও জনপ্রতিনিধিই আংটি চাটুজ্জের ভাইয়ের সঙ্গে কস্মিনকালে পরিচিত হননি।
ইউলিসিসের প্রণেতা জেমস জয়েসের ডাবলিন শহর লেখকের স্মৃতিরক্ষায় যত উদ্যোগ নিয়েছে তার সিকিভাগ এক্ষেত্রে নেওয়া হলে আমরা বর্তে যেতাম।
কালিম্পংয়ে রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত একটি ভবনও ভেতরে ঢুকে দেখার কোনও পরিস্থিতি নেই। আলিপুরদুয়ারের বক্সা পাহাড়ের সেই ‘মেঘের গায়ে জেলখানা’র সংস্কার হলেও সেই সংস্কারকাজে ইতিহাস রক্ষার নিয়মনীতি মানা হয়নি।
শুধুই কি নেই নেই করে যেতে হবে। তেমনটা একেবারে চাই না। কিছু উত্তরণ থাক, আলো আসুক।
স্বামী নিত্যসত্যানন্দ মহারাজ, সবাই ডাকতেন বিশ্বরূপ মহারাজ। তাঁর পরিশ্রম ও ঐকান্তিক চেষ্টায় দার্জিলিংয়ের রায় ভিলা রামকৃষ্ণ মিশন নতুন প্রাণ পেল। এই বাড়িতেই ১৯১১-র শরৎকালে পৃথিবী ছাড়েন মহাপ্রাণ নিবেদিতা। কিন্তু তাঁর সমাধি ভেঙে পড়েছিল। রায় ভিলা হয়েছিল ভূতের বাড়ি। পর্যটকরা ধারপাশ মাড়াতেন না। অল্প সময়ে সবকিছু সাজিয়ে ফেলেছিলেন এই মহারাজ। নিবেদিতা যাবার আগে অবলা বসুকে (জগদীশচন্দ্র বসুর স্ত্রী) বলেছিলেন; ‘নৌকা চলে যাচ্ছে, কিন্তু আমি সূর্যোদয় দেখবো।’ মাত্র ৫৯ বছর বয়সে চলে গিয়েছেন বিশ্বরূপ মহারাজ। যাবার ক’দিন আগে এক ভক্তকে লিখেছিলেন, ‘লম্বা ছুটিতে যাচ্ছি রে।’
তিব্বত, সিকিম, শিলিগুড়ি, দার্জিলিং সবটাই বিনা মোটরগাড়িতে সওয়ার হয়ে চষে ফেলেছিলেন রাহুল সাংকৃত্যায়নও। ‘তিব্বতে সওয়া বছর’ থেকে উদ্ধার করেছিলেন প্রচুর প্রাচীন পুঁথি। দেহ রাখেন এই দার্জিলিংয়েই। বৌদ্ধ দর্শন রাহুল সাংকৃত্যায়নকে যেভাবে প্রভাবিত করেছিল তেমনভাবেই প্রায় ১৫০০ বছর আগে এক চৈনিক যুবক এদেশে এসেছিলেন। হিউয়েন সাং! উত্তরবঙ্গের এই নিভৃতিতেও নাকি তাঁর পদচারণা হয়েছিল। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁকে নিয়ে এক বড় লেখা ভেবেওছিলেন। ‘ছায়া দর্শন’ নামের এক গল্পও লেখা হয়েছিল। কিন্তু বড় কাজটি আর করে যেতে পারেননি।
চলুক গবেষণা, নানা দিকে, নানাভাবে। তাহলেই উত্তরের এই সংগ্রহশালা পূর্ণতা পাবে। এই পশ্চিমবঙ্গ নামক রাজ্যের উত্তর দিকের ইতিহাসের পাতার এখনও অনেকটাই সাদা। দ্রুত প্রযুক্তির বাঁকবদল হচ্ছে, এখন মোবাইল ফোনে এআই ঢুকতে শুরু করেছে। অনেক প্রশ্নের জবাব খুঁজতে আর কলকাতামুখী যে হতে হবে না একথা বলাই বাহুল্য। তীব্র অনলাইন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে প্রান্তিক শব্দটি লুপ্ত হবে। সেক্ষেত্রে উত্তরের এক নতুন উত্তরণের পথ খোলা থাকছে।