আবহাওয়া দফতর বলছে পুজোয় এবার বৃষ্টি হবে। দুর্গাপুজোর সঙ্গে কত মানুষের ভবিষ্যৎ জড়িয়ে– তা কি প্রকৃতি বোঝে?
‘কোন্ খেপা শ্রাবণ ছুটে এল আশ্বিনেরই আঙিনায়’– ৫৪ বছরের রবীন্দ্রনাথ এ গান লিখেছিলেন ১৩২২ সালের আশ্বিন মাসে, ১৯১৫-র সেপ্টেম্বরের একেবারে শেষের দিকে, অক্টোবর তখন প্রায় ছেঁায়া-দূরত্বে। গান-রচনার ঠিক তারিখটা জানা যায়নি। কিন্তু এটুকু বলা যাচ্ছে, ভরপুর শরৎ। পুজো এল বলে। শরতের শান্তিনিকেতন আলোয় ভাসছে। এবং রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে। হঠাৎ ‘দুলিয়ে জটা ঘনঘটা পাগল হাওয়া’-য় ভেসে এল মেঘ। আর এমন আকস্মিক অপ্রত্যাশিত বৃষ্টি যে, রবীন্দ্রনাথ লিখতে বাধ্য হলেন, আশ্বিনের আঙিনায় খেপা শ্রাবণের এ কী পাগলামি! আশ্বিনের আঙিনায় শ্রাবণের এই উন্মাদ অনুপ্রবেশ কিছুক্ষণের মধ্যেই কিন্তু বেশ লাগল রবীন্দ্রনাথের। রবীন্দ্রনাথ আনন্দে একই গানে লিখলেন, ‘মাঠে মাঠে পুলক লাগে ছায়ানটের নৃত্যরাগে,/ শরৎ-রবির সোনার আলো উদাস হয়ে মিলিয়ে যায়।’
এবার বেশ কিছু বছর পিছিয়ে যাওয়া যাক। ২০ অক্টোবর ১৮৯৪। পুজোর সময় ৩৩ বছরের রবীন্দ্রনাথ একা, বোলপুরে। লিখছেন একটি চিঠিতে: ‘কাল রাত্তির থেকে অল্প অল্প মেঘ করে আসছে। আকাশের ধারে ধারে স্তূপাকার কালো মেঘ জমেছে এবং সূর্যালোকে তাদের পাড়গুলো শুভ্র জ্যোতির্ময় হয়ে উঠেছে। মাঠের চারিদিক নতুন আমন ধানের গাঢ় এবং সরস সবুজবর্ণ ধারণ করেছে, তার উপর স্নিগ্ধ মেঘের আভা দেখাচ্ছে ভাল।’ ঠিক পঁাচ দিন পরে, শরতের সোনালি রোদ মুছে দিয়ে, নামল বর্ষা আর কী আনন্দ রবীন্দ্রাথের: ‘কাল রাত্তির থেকে খুব ঘন ঘোর বর্ষা করে এসেছে। কাল সমস্ত রাত্তির সবেগে বাতাস দিয়ে সশব্দে বৃষ্টি হয়ে গেছে। আজ সকালে সমস্ত আকাশ মেঘাচ্ছন্ন করে বৃষ্টি হচ্ছে। একে তো বোলপুর
নির্জন, তাতে চতুর্দিকের আকাশমণ্ডপে কালো মেঘের পর্দা টেনে দিয়ে আরও গভীর নিভৃত বলে বোধ হচ্ছে।’
আমাদের প্রশ্ন: রবীন্দ্রনাথ যেভাবে শরতের বৃষ্টিতে আন্দোলিত ও আনন্দিত হচ্ছেন, আমরা কি তা হচ্ছি? আবহাওয়া দফতরের ভবিষ্যদ্বাণী, এ-বছর পুজোর সময় ঝড়-বৃষ্টির প্রবল সম্ভাবনা। প্রকৃতির এ কি বাঙালি বিরোধিতা! বাঙালির সেন্টিমেন্ট বোঝে না! আসলে সমস্যাটা হল, বাঙালি বদলে গিয়েছে। প্রকৃতি বদলায়নি। রবীন্দ্রনাথ সেই বাঙালি– যিনি বারোয়ারি পুজোর হুল্লোড়, মজা, রাতজাগা উত্তেজনা, দল বেঁধে ঠাকুর দেখা, পুজো শপিংয়ের উত্তেজনা, পুজোর ভিড়ের প্লাবন, পুজোর সিনেমার হুজুগ, পুজোর প্রেমের হিড়িক, পুজোর ফ্যাশন, পুজোর ভ্রমণ, পুজোর খাওয়াদাওয়া, এবং মণ্ডপে পুজোর থিম– এসব কিছুই জানতেন না। তঁার ধারণাই ছিল না– মা দুর্গা হয়ে উঠতে পারেন কত বড় বাণিজ্যকেন্দ্র এবং বাৎসরিক নেশা। পুজোর রাজনীতি– তারই-বা কতটুকু জানতেন তিনি! পুজোর ভিড়। পুজোর চঁাদা। পুজোর মস্তানি।
পুজোর প্রতিযোগিতা। পুজোয় ক্ষমতার প্রচার ও প্রসার। এখনকার দুর্গাপুজোর বৈচিত্রের কাছে তিনি ডেটেড। অনাধুনিক। তাই তো আশ্বিনের আঙিনায় খেপা শ্রাবণের অনুপ্রেবেশেই রবীন্দ্রনাথের অম্লান আহ্লাদ!