আলু ‘হৃদয়-হরা’! বাঙালির পাত আলো করা এই সবজি কীভাবে ঢুকল হেঁসেলে?

আলু ‘হৃদয়-হরা’! বাঙালির পাত আলো করা এই সবজি কীভাবে ঢুকল হেঁসেলে?

ইন্ডিয়া খবর/INDIA
Spread the love


বিশ্বদীপ দে: একটা মিম দিয়ে শুরু করা যাক। ফ্রিজের ভিতরে রাখা সবজির দল। তাদের গায়ে জমে থাকা জলবিন্দু যেন এক বিলাসযাপনের সংকেত। অন্যদিকে সারা মুখে ধুলো মাখা এক মানুষের মলিন মুখ। তলায় লেখা ‘খাটের তলায়’ থাকা আলু। আমাদের জীবনে আলু ও এবং বাকি সবজির শ্রেণিগত অবস্থানের এক আশ্চর্য কৌতুকপূর্ণ অথচ করুণ ছবি ফুটে ওঠে এই মিমে। কিন্তু আপাত ভাবে হেলাফেলায় খাটের তলায় পড়ে থাকা আলুর ইউএসপি মোটেই কারও চেয়ে কম নয়। বরং বাকি সবজিদের সে বলে বলে গোল দেয়। কাজেই আলু মোটেই আলোবিহীন নয়। বরং পাতে তার দেখা না পেলে অনেকেরই মুখ হাঁড়ি হয়ে যায়। এমনকী, বিরিয়ানির হাঁড়িতেও চিকেন-মাটনের ঔজ্জ্বল্যের মাঝেও তাকে চাই! চাই-ই চাই। অথচ চারশো বছর আগে কেউ এই বঙ্গদেশে আলুর ব্যবহারই জানত না। নামটাও শোনেনি। তবে কীভাবে আলু এল বাঙালির পাত আলো করে?

ইউভাল নোয়া হারারির লেখা ‘স্যাপিয়েন্স: আ ব্রিফ হিস্ট্রি অফ ম্যানকাইন্ড’ নামের এক অসামান্য বইয়ে মানবজাতির ইতিহাস, বিবর্তনের সরস বর্ণনা রয়েছে। সেখানে মজা করে বলা হয়েছে, এই আদিম মানুষ প্রথম ‘কলোনাইজড’ হয়েছিল গমের হাতে! কেননা কৃষিজীবী হয়ে পড়ায় গম ব্যবহারের বাধ্যতাতেই মাইলকে মাইল জমিতে গমের উৎপাদন করতে বাধ্য হয়েছিল মানুষ। এই মজার মন্তব্য বাঙালির জীবনে আলুর ক্ষেত্রেও কি খাটে না? এই বঙ্গদেশে প্রথম উপনিবেশ বোধহয় আলুই গড়েছিল।



ভ্যান গঘের ‘দ্য পটাটো ইটার’

অবশ্য কেবল বাঙালির কথা বলে লাভ নেই। আলুর হাতে বশ কোন মহাদেশ হয়নি! তবে এই লেখা কেবল বাঙালি ও আলুর নিবিড় রসায়ন নিয়ে। সেখানে বাকিদের প্রবেশাধিকার নেই। কিন্তু সেখানে পৌঁছনোর আগে যেটুকু না বললেই নয় তা হল ষোড়শ শতক পর্যন্ত গোটা পৃথিবীতে একমাত্র পেরুতেই আলুর প্রচলন ছিল। আন্দিজ পর্বতমালায় নাকি প্রথম আলুর চাষ হয়েছিল। কিন্তু এরপর ইউরোপীয় বণিকরা সেটার নাগাল পায়। আর ধীরে ধীরে ছড়িয়ে বিশ্বের কোনায় কোনায়। তবে পর্তুগিজরাই যে এদেশে প্রথম আলু নিয়ে এসেছিল সেকথা কার আর জানতে বাকি। সপ্তদশ শতকের প্রথম দিকে পর্তুগিজ নাবিকরা এদেশে প্রথম আলু নিয়ে আসে বলে অনুমান। কিন্তু তাদের জাহাজে বস্তা বস্তা আলু থাকত কেন? এই সবজির প্রতি তাদের এহেন পক্ষপাতিত্বের মূল কারণ কী? আসলে দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রায় আলুর মতো আর কে আছে! কেননা আলুতে সহজে পচন ধরে না। যাত্রার নানা ঝুটঝামেলার মধ্যে সেদ্ধ করেই তা গলাঃধকরণ করে ক্ষুণ্ণিবৃত্তি করে ফেলা যায়। পেটটাও ভরা থাকে। সুতরাং ‘এমন বন্ধু আর কে আছে?’

যাই হোক, পর্তুগিজদের পাল্লায় পড়ে ভারতীয়রা আলু খাওয়া শিখে ফেলল। কালিকট বন্দরের শ্রমিকরা তো রীতিমতো আলু-ভক্ত হয়ে উঠল! কিন্তু বাংলায় আলুর প্রবেশের পিছনে ছিলেন বাংলার প্রথম গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস। তিনি চেয়েছিলেন এদেশের মাটিতে আলুর ফলন করতে। তারপর সেই আলু ইউরোপ জুড়ে ছড়িয়ে দিতে। এই সময়ই অন্যান্য জায়গার মতো কলকাতাতেও আলু চাষ করা শুরু করে ব্রিটিশরা। এদিকে অন্য একটা মত বলছে, মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে কলকাতায় আলু জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। মনে রাখতে হবে, মুঘলরা কিন্তু সেই সময় আলুকে তাদের প্লেটে ‘মাস্ট’ করে তুলেছিল। আর তাদের হাত ধরেই এই পোড়া বাংলাদেশেও ঢুকে পড়ে আলু।

আলুর সঙ্গে বিরিয়ানির এমন নিবিড় সখ্যের পিছনেও বাঙালিই। কেউ কেউ তো মনে করেন, বিরিয়ানিতে আলু না থাকলে মাটন-চিকেনের আভিজাত্যও মাঠে মারা যায়। মায় ‘আলু বিরিয়ানি’ নামের একটা পদও বাঙালি আবিষ্কার করে ফেলেছে! যাই হোক, নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ ‘যব ছোড় চলে লখনউ নগরী’, তারপর বাংলায় এসে এখানেই বিরিয়ানির প্রচলন করেন। কিন্তু নবাবের বাবুর্চিরা এতে আলু মিশিয়ে ফেলে। সেই থেকেই বিরিয়ানির সঙ্গে আলুর অমোঘ পার্টনারশিপের সূচনা।

potato

তবে আলুকে সইতে হয় নানা বদনাম। বেশি খেলে রক্তে শর্করা বাড়ে। সুগারের রোগীদের জন্য একেবারে ‘বিষবৎ’! শরীরে ফ্যাট, সোডিয়াম ও ক্যালরির পরিমাণ বেড়ে যেতে থাকে তেলে ভেজে খেলে। আবার অ্যাসিডিটিও হতে পারে। এমনই নানাবিধ। কিন্তু এসব বলেও বাঙালিকে দমানো গেল কই। মোদ্দা কথা আলু বাঙালির জীবনে এক এমন উপাদান, যাকে ছাড়া কল্পনাই করা যায় না। গোপাল ভাঁড়ের সেই গল্পটা মনে পড়ে? আলুর গুদাম পুড়ে গেলে গোপাল নুন জোগাড় করে পোড়া আলুর সঙ্গে মিশিয়ে খেয়ে যাকে বলে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল। তারপর মুগ্ধতার বশে সোজা গুদামের মালিককে গিয়েই জিজ্ঞেস করে বসে, ”দাদা, আলুর গুদাম ফের কবে পুড়বে?” রসিক গোপালের রসনাসম্ভূত এই প্রশ্নের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে বাঙালির আলুপ্রীতির আবেদনের প্রতীকী প্রকাশ।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ






Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *