আমার মরণে হয়নি তো হেডলাইন

আমার মরণে হয়নি তো হেডলাইন

ব্যবসা-বাণিজ্যের /BUSINESS
Spread the love


 

  • সন্দীপন নন্দী

‘রবীন্দ্র গল্প সেভাবে টানে না। নিজের লেখার জন‍্য বিভূতি, মানিক একটু আধটু পড়তে হয়।’ ছোট মুখে বড় কথা শোনালেও দেওয়াল আর পিঠের সঙ্গে সমঝোতা করা শহর বালুরঘাটের চৈতালি সন্ধ‍্যায় কথাগুলো বলেছিলেন পীযূষ ভট্টাচার্য। বাংলা সাহিত‍্যের এক ব‍্যতিক্রমী গদ‍্যকার।

তিনি আজন্ম বেস্ট সেলার হতে চাননি, হতে চাননি সাহিত‍্যবাসরের আলোকময় সভাপতি কিংবা প্রকাশকের প্রভু। বরং ‘আমিও তুমুল হৃদয়ধ্বনির ভিতর চোখ বুজি, অরণ‍্যের কপাট হাট করে মেলে ধরি’ অথবা ‘তরাইয়ের মেঘ গলিত ধাতুর মতো সগর্জন নেমে প্রতিমা ছাঁচে স্বর্ণমূর্তি হয়ে যায় হেমন্ত’ লিখেছেন বাংলা সাহিত‍্যের চিরাচরিত গদ‍্যধারাকে চুরমার করে দেওয়া উত্তরবঙ্গের অভিমানী দূরত্বের একজন লেখক। নবারুণ ভট্টাচার্য, অমিয়ভূষণ মজুমদারদের মনে করাতেন তিনি।

তাই তো অক্লেশে জনবহুল ফুটপাথের নগণ‍্য চেয়ারে বসেই একদা তিনি হয়ে ওঠেন অশীতিপর ‘বার্থডে বয়’। উৎফুল্ল উন্নাসিকের মতো বলতে পারেন, লেখকের সামাজিক দায়বদ্ধতা বলে কিছু হয় না, সবটাই সত‍্যের পৌরাণিক স্তূপখনন।

ফলে মনসামঙ্গলকে প্রতিহিংসামূলক জার্নি বলতে যার বাঁধে না, তাঁর সাহিত‍্যকর্ম যে বহুপাঠ‍্য হবে, তা অবিশ্বাস‍্য। তাই চিরকাল তরুণ লেখক আর বাজারি রংচঙে গল্পসমগ্রের মাঝে এক অনামী প্রাচীর তুলে ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন পীযূষ। লেখা ফিঙ্গারপ্রিন্টের মতো, মেলে না রে মেলে না, এ তো তাঁরই কথা। কখনও কথাও যে এভাবে কোথাও  মন্ত্রের রূপ নেয়, যাকে আমৃত‍্যু অস্বীকারের উপায় থাকে না।

ইচ্ছামৃত‍্যু নাকি নির্বাসন? প্রাতিষ্ঠানিক শামিয়ানামুক্ত এক ছিন্নপথের লেখক হয়েই আত্রেয়ীপারে কাটিয়ে গেলেন। তাই বাণিজ‍্যিক কাগজে অনাবিষ্কৃত থেকে গিয়েছেন লোকটি। বিবাহ হতে জন্মদিনপ্রহরে স্বজনের হাতে তুলে দিতেন, সাহিত‍্য আকাদেমি পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করা লেখক ভৈকুম বশীরের গদ‍্য সংগ্রহ, মাধ‍্যমিক পাশ নাতনিকে বইমেলায় কেনার জন্য জগদীশ গুপ্ত, অমিয়ভূষণ রেকমেন্ড করতেন।

তাই দেবেশ রায় বলেছিলেন, ‘পীযূষের লেখার গন্ধ পেলে তো পেলে, না পেলে পেলে না।’ আসলে মৃত‍্যু আসে না, মেনে নিতে হয়। মৃত‍্যুপূর্বে দলছুট হাতির নিঃসঙ্গতাকে তাই অপূর্ব মৃত‍্যুচেতনার নকশা বলে মেনে নিয়েছিলেন মানুষটি। আর মহাশ্বেতা দেবীর ফোন এলে তন্ময় হয়ে শুনতেন, মনে হত যেন তখন সাহিত‍্যের ক্লাস চলছে। বলতেন, যা দেখি তাই লিখি। লেখার শুরুতেই ভাবতে হবে, এ বিষয়ে পৃথিবীর সব ভাষায় লেখা হয়ে গিয়েছে। যা লিখছি, পুরোটাই যেন হয়ে ওঠে অভূতপূর্ব, অপঠিত। তবেই লেখা, লেখা হয়ে উঠবে।

‘ইংরেজি ভাল লিখতে পড়তে পারি না’ এই অপারগতার ডিসক্লেইমার দেওয়াটাও তো একজন সৎ লেখকের দায়বোধ। তাই মার্কেজ, মুরাকামির অনুবাদ লেখা খুঁজে খুঁজে পড়তেন পীযূষ।

ওঁর কাকমারা জংশন, জ‍্যোৎস্নালোকে হুইলচেয়ার, ঠাকুমার তালপাখা, নদী পুড়ে যায়-এর মতো গল্পে জাগ্রত পাঠক যেন শিক্ষিত হবার দিকে ঝোঁকেন। তাঁকে পড়তে থাকে, পড়তেই থাকে, ঘোরের মধ‍্যে। অথচ জানি পীযূষের গল্পে কোনও বস্তুগত টান নেই, পরিণতিহীন সম্পর্কের বা মগ্ন মানবের কিছু উদ্ভাস শেষপর্যন্ত বরাদ্দ নেই পাঠকের জন‍্য। তাই এ লেখক পাঠকদের জন‍্য রাখেন শুধু এক পরিসর, যা পাঠককে পৌঁছে দেয় এক নতুন ডিসকোর্সে, নতুন চিহ্নকের দৌত‍্যে। যে লিখে গিয়েছেন, আকাশ কলকাতার মতো লম্বা, চৌকো, নানা কিসিমের ফ্রেমে বাঁধানো নয়, এ বিরাট আকাশ খোলা। নীচে ছোট্ট অক্ষরে লেখা ‘আমার মরণে হয়নি তো হেডলাইন’।

(লেখক বালুরঘাটের বাসিন্দা। প্রবন্ধকার)



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *