অস্তিত্ব জানান দিয়েছিল মিশরের মমি – Uttarbanga Sambad

অস্তিত্ব জানান দিয়েছিল মিশরের মমি – Uttarbanga Sambad

ব্লগ/BLOG
Spread the love


  • অচিন্ত্য সরকার

 

২০০৭ সালের মাঝামাঝি। দিল্লির জনবহুল এলাকা। স্থানীয় থানায় ফোন আসে। রাস্তায় পড়ে আছে ট্রলিব্যাগ। তা থেকে চোঁয়াচ্ছে রক্ত। পুলিশ আসে। ব্যাগে মেলে মুণ্ডহীন এক তরুণীর দেহ। তদন্তে নামে হোমিসাইড শাখা। তৈরি হয় বিশেষ টিম। দলের প্রধান প্রশান্ত রাও। কিন্তু তদন্তে সেভাবে ফল মিলল না। উন্নত প্রযুক্তি, গবেষণা, কৌশল সব প্রয়োগ। তবুও অগ্রগতি নেই। অবশেষে হাল ছাড়লেন। শেষবারের মতন ভিক্টিমের ছবিগুলো দেখছেন। হঠাৎ চোখে পড়ল মৃতদেহের ডান হাতের কবজিতে ছোট আকৃতির একটি প্রজাপতির ট্যাটু। ছবিটি ফরেন্সিক ল্যাবে পাঠালেন। রিপোর্ট এল ট্যাটুটি মৃত্যুর পাঁচ-ছ’দিন আগে করা। আবার নামলেন তদন্তে। দিল্লির সমস্ত ট্যাটু পার্লার হন্যে হয়ে খুঁজলেন এমন ট্যাটু যাঁরা করেছেন তাঁদের পরিচয়। ১৩ জনের হদিস মিলল। পুলিশ দেখে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করে সেই ১৩ জনের মধ্যে অষ্টম দানিশ আগরওয়াল। পাকড়াও করেন প্রশান্ত রাও অ্যান্ড কোং। পরে সেপটিক ট্যাংক থেকে উদ্ধার হয় সিলভিয়া পুনমের কাটা মুণ্ডুটি। আশ্চর্যের বিষয়, তদন্তে এত প্রযুক্তি, কৌশল ব্যবহার করেও যেখানে অসফল সেখানে সামান্য একটা ট্যাটু ধরিয়ে দিল মূল অপরাধীকে। হালে ২৪ পরগনা, কাটোয়ার ঘটনাগুলির কিনারা করেছে ভিক্টিমের শরীরে আঁকা ট্যাটুগুলো। এমন অনেক ঘটনা আছে যার রহস্যের কিনারা করেছে ট্যাটু। এমনকি দীর্ঘদিনের হারানো মানুষকে খুঁজে দিয়েছে শরীরে খোদাই করা উলকি।

ট্যাটু অনেক গভীর রহস্য উন্মোচন করলেও তার নিজের জন্মরহস্য আজও স্পষ্ট নয়। সব তথ্যই গবেষণালব্ধ অনুমানমাত্র। তবে নয়ের  দশকে নৃবিজ্ঞানী ডানিয়েল আঁতোনি যে মিশরীয় মমিটি পেয়েছিলেন তার পিঠে ও বাহুতে দেখা গিয়েছিল বিশেষ কিছু চিহ্ন। প্রথমে ভাবা হয়েছিল এগুলি কোনও শারীরিক আঘাত। পরে অত্যাধুনিক যন্ত্রের সাহায্যে জানা যায় সেগুলো এক ধরনের নকশা। বুনো ষাঁড়  বা বাঁকা শিংওয়ালা ভেড়া জাতীয় কোনও প্রাণীর ছবি। মমির জনৈক ব্যক্তিটি ছিল ৩৩৫১-৩০১৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মানুষ। পরবর্তী গবেষণায় উঠে আসে মিশর, সিন্ধু সভ্যতা, জাপান, চিন প্রভৃতি বিশ্বের বিভিন্ন সংস্কৃতিতে শতাব্দীর পর শতাব্দী ট্যাটুচর্চা চলে আসছে।

হাজার হাজার বছর ধরে ট্যাটু মানবসভ্যতার এক ঐতিহ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। ট্যাটু মানুষের আত্মপ্রকাশ, পরিচয় ও শৈল্পিকতার মাধ্যম বহন করে। মধ্যযুগীয় সভ্যতায় দাস, যোদ্ধা, ফ্যারাও, নাবিক প্রভৃতি গোষ্ঠীর মানুষরা নির্দিষ্ট ঘরানার প্রতীক ট্যাটু হিসেবে ব্যবহার করত। ট্যাটুগুলি ছিল তাদের পরিচয়পত্র। আজও এই প্রথা ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে কিছু জনজাতি ও আদিবাসীদের মধ্যে বিদ্যমান। শুধু তাই নয়, এরা তাদের গোষ্ঠীর মেয়েদের মুখে বিকৃত ট্যাটু এঁকে কুৎসিত করে দেয় পুরুষদের কুনজর থেকে বাঁচানোর জন্য।

আগে উলকি ব্যবহার করা হত ধর্মীয়, সামাজিক কিংবা চিকিৎসার উদ্দেশ্যে। মহিলাদের সুস্বাস্থ্য ও প্রজনন ক্ষমতার প্রতীক হিসেবে। সেনা-যোদ্ধাদের ট্যাটু তাদের শৌর্যবীর্য ও দক্ষতার মান বোঝাতে। বর্তমান সমাজে উলকি সাজসজ্জার অলংকরণ হলেও প্রতিটি ট্যাটুতে খোদাই থাকে প্রেম, ভক্তি, স্মৃতি ও আবেগ। মুম্বাইয়ের এক দম্পতি শরীরে  ট্যাটু করেছেন তাঁদের একমাত্র সন্তানের চিতাভস্মের ছাই ট্যাটুর কালিতে মিশিয়ে। বিয়ের ২৫ বছর পর বাবা হওয়ার আনন্দে নবজাতকের পায়ের ছাপ বুকে ট্যাটু করে  রেখেছেন কেউ।

হলিউড বলিউডের চিত্রতারকা থেকে খেলোয়াড়, গায়ক সকলে ট্যাটুকে সাদরে গ্রহণ করেছেন। সইফ আলি খানের হাতে খোদাই আছে ‘করিনা’। কঙ্গনা রানাওয়াত তাঁর ঘাড়ে ট্যাটু করেছেন মুকুট ও ডানা এঁকে। তাঁর মতে এটি শক্তি ও স্বপ্ন উড়ান-কে প্রতিনিধিত্ব করে। প্রিয়াংকা চোপড়ার হাতে লেখা ‘ড্যাডিজ লিল গার্ল’ ট্যাটুটি খুবই জনপ্রিয়। অক্ষয়কুমার তাঁর পেশিবহুল কাঁধে তুলে রেখেছেন ছেলের নাম। অভিনেতা জন আব্রাহাম ট্যাটু খোদাই করেছেন কোমরের নীচে ইনজেকশন দেওয়ার জায়গায়। ফুটবল তারকা লিওনেল মেসি যখন যা মনে করেন তাই খোদাই করেন নিজের শরীরে। মায়ের ছবি, স্ত্রীর ভুবনমোহিনী চোখ, সন্তানদের নাম। তাছাড়া কেটি পেরি, ডেভিড বেকহাম, লেডি গাগা আমাদের ক্রিকেটার শিখর ধাওয়ান ,বিরাট কোহলি প্রমুখরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ট্যাটু এঁকেছেন শরীরে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের মারকাটারি ডানপিটে ব্যাটার ক্রিস গেইলের ভাইরাল ট্যাটু দেখার মতো। কিছু কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তির শরীরেও বিভিন্ন সময়ে ট্যাটু দেখা গেছে। এলেন ওয়েস্ট, জাস্টিন ট্রুডো প্রমুখ। আমাদের মিমি চক্রবর্তী, নুসরাত জাহানরা উলকি করিয়েছেন। তবে ভারতের প্রথম সারির রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ট্যাটু আছে কি না তা প্রকাশ পায়নি। কিন্তু যোগী আদিত্যনাথ ও নরেন্দ্র মোদির মুখের ছবি বহু ভক্তের শরীরে ট্যাটু হিসেবে বিদ্যমান।

হুজুগে বাঙালির ট্যাটু নিয়ে মাতামাতি কম নেই। বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন রচনায় ট্যাটু বা উলকির কথা আছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মুজতবা আলির মতো অনেকের সৃষ্টিতেই উলকি এসেছে বারবার। ‘কড়াপড়া কঠিন…কাঁকনটা/কপালে তার পত্রলেখা উল্কি-দেওয়া আঁকনটা’। দিন-দিন আমাদের বাঙালির পুরুষ-নারী মহলে ট্যাটুর গ্রহণযোগ্যতা যেন বাড়ছে। বিশেষ করে তরুণ–তরুণী ও মাঝবয়সি নারী-পুরুষদের মধ্যে। লিঙ্গবৈষম্য ও ব্যক্তিগত রুচিবোধ হিসেবে ট্যাটুর ছবি ভিন্ন ভিন্ন হয়। ছেলেদের দেখা যায় ডানা মেলা বৃদ্ধ শকুন, শিকারি ইগল, কাঁকড়াবিছে, সাপ, ড্রাগন কখনও বা বিভিন্ন দেবদেবীর ট্যাটু করাতে। রামায়ণে হনুমান বুক চিরে দেখিয়েছিলেন রামের মূর্তি। এখন ছেলেদের জামা-গেঞ্জি ছিঁড়লে বেরিয়ে আসবে রাম, শিব বা বজরঙ্গবলী। মেয়েদের পছন্দের ট্যাটু হল প্রজাপতি, ময়ূরের পালক অথবা সংগীতের কোনও নোটেশন। প্রসঙ্গত, ড্রাগন বাংলায় অগ্নিমুখী সিন্ধুঘোটক ট্যাটুটি আমদানি হয়েছে চিনের ট্যাটু সংস্কৃতি থেকে।

ট্যাটুতে শরীর সাজালে এর জ্বালাও ভোগ করতে হয়। ট্যাটুর জন্য প্রয়োজন সুচ সংযুক্ত ট্যাটু গান। সুচ দিয়ে ত্বকের স্তরে কালি ঢুকিয়ে অঙ্কন করা হয় মনপসন্দ নকশা। সুচ ত্বকের এপিডার্মিস স্তরকে ছিদ্র করে দ্বিতীয় স্তরে পৌঁছায়। কোলাজেন তন্তু, রক্তবাহী নালি প্রভৃতি নিয়ে গঠিত এই স্তরে যখন সুচ কালি ছাড়ে তখন রক্তে থাকা শ্বেতকণিকা শক্তিশালী হয়ে ওঠে। অবৈধ অনুপ্রবেশ শরীরে ঢুকেছে দেখে শ্বেতকণিকা কালিতে থাকা কণাগুলির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। তৈরি করে ম্যাক্রোফেস জাতীয় স্পেশাল টাস্ক ফোর্স। যা আদতে ‘রাক্ষুসে’ রোগ প্রতিরোধক কোষ। কিন্তু কালির কণাগুলোর সঙ্গে যুদ্ধে এরা হার মানে। কণাগুলোকে এরা নষ্ট করতে পারে না। অতএব, যে চিত্র আকারে সুচ দিয়ে কালি ঢালা হয়েছিল সেই আকারে কালিগুলো স্থায়ী হিসেবে ত্বকে রয়ে যায়। ট্যাটুর আভিজাত্য, লালিত্য ও সৌন্দর্য অর্ধেকটা নির্ভর করে ট্যাটুশিল্পীর দক্ষতা ও কালির মানের ভিত্তিতে। বাকিটা নির্ভর করে ট্যাটুকারীর ত্বকের গঠন ও প্রকৃতির উপর। থাইল্যান্ডের বৌদ্ধ ভিক্ষুরা যে পদ্ধতিতে ট্যাটু করেন তা বৈজ্ঞানিকভাবে স্বীকৃত ও নিরাপদ। এঁরা উলকি আঁকেন বিশেষ এক ধরনের বাঁশের তীক্ষ্ণ ফলা দিয়ে। ব্যবহার হয় জৈবিক কালি। শিল্পীরা অভিজ্ঞ ও দক্ষ। যন্ত্রণা বেশি কিন্তু ঝুঁকি কম।

ট্যাটু নিয়ে বহু মিথ প্রচলিত আছে। যাঁরা ট্যাটু করেন তাঁরা নাকি রক্তদান করতে পারেন না। এটা সার্বিক সত্য নয়। ট্যাটু করার ছয় মাস পর অবশ্যই রক্তদান করা যায়। তার আগেই পরীক্ষা করে নেওয়া হয় ট্যাটু করার জন্য দাতার রক্তে কোনও প্রকার সংক্রমণ ঘটেছে কি না। তবে শরীরে ট্যাটু থাকলে বেশ কিছু চাকরিতে যে নিয়োগ হয় না এর প্রমাণ আমার পড়শি ছেলেটি। অনেকটা পথ পেরিয়ে ট্যাটু এখন সাবেকিয়ানা সাজের অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ট্যাটু এখন অখণ্ডমণ্ডলাকার চরাচরব্যাপ্ত। সমাজে ট্যাটু নিয়ে নানা মুনির নানা মত। সমাজের রক্ষণশীল শুকনো সন্ন্যাসীরা বলবেন, ট্যাটু করা ঠিক নয়। ঈশ্বরের দেওয়া এই শরীরকে কৃত্রিমভাবে কালিমালিপ্ত করা কেন। কে শরীরে ট্যাটু করবে আর করবে না, তা তার সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত বিষয়। যেমন ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো এত বড় সেলেব্রিটি হয়েও তাঁর শরীরে কোনও উলকি নেই। ইদানীং ট্যাটুচর্চা যে মানবসমাজের একটা ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও শিল্প তা অনস্বীকার্য। তবে এটা সত্য যে, এই দেহমন্দিরে থাকা প্রতিটি ট্যাটুই কিন্তু জানান দেয়, কিছু না বলা কথার। কিছু না জানা গল্পের।



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *