অন্ধকারের আড়ালে আলোর গল্প

অন্ধকারের আড়ালে আলোর গল্প

ভিডিও/VIDEO
Spread the love


  • দেবরাজ রায়চৌধুরী

জানেন তো আলোতেই বুকটা কেমন সারাক্ষণ ধুকপুক করে, এই বুঝি চলে যাবে কারেন্ট। বরং লোডশেডিংই ভালো, মনে তবু একটা আশা থাকে কখন জ্বলে উঠবে সব বাতি… তিনবাত্তি মোড়ে রিকশা চালাতে চালাতে দার্শনিকের মতো হক কথা বলেছিল জুলফিকর হক, পেছনের সিটে সওয়ারি আমি প্রশ্ন করেছিলাম, ‘এই অন্ধকারে রিকশা চালাতে তোমার অসুবিধা হয় না জুলফিকর?’ এসব গত শতকের এক লোডশেডিং এবং তারাভরা রাতের গপ্পো, এখনও মনে আছে। তারপর মহানন্দা দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে, আজ লোডশেডিং উধাও। বেফিকর সব টোটো কোম্পানির দাপটে উধাও তার রিকশা সমেত জুলফিকর হকও।

আমাদের ছোটবেলায় মানে আশির দশকের গোড়ায় দেখতাম মাঝেমধ্যেই খবরের কাগজে হেডিং লোডশেডিং, তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর ছোট্ট নামে কত আলো কিন্তু রাজ্যে আলো নেই, এই নিয়ে কত ব্যঙ্গ বিদ্রুপ সাংবাদিকদের, বিরোধী দলের… চোখে পড়ত বিখ্যাত দৈনিকের পাতায় আবছা মনে আছে। আজ সেইসব অন্ধকারের রাত অতীত, লন্ঠন, মোম, কুপি, হ্যারিকেন, হ্যাজাক, হাতপাখার হাওয়া এবং বেগড়বাই করলেই তার ডাঁট দিয়ে পিঠে… সব এখন বিগত গরমকালের নরম নস্টালজিয়ার অংশ… আহা তবু বুঝি কত ভালো ছিল সেইসব মোমের আলোয় দেওয়ালে ছায়াবাজির রাত, অন্ধকারে পড়া বাদ দিয়ে আরও কত কী করার সেই সমস্ত ফুরসত।

এখন চারদিকে এত আলো চোখ ধাঁধিয়ে যায়। কোথাও একটু আঁধারের আবছায়া নেই। সে না থাকুক তাতে কোনও আপত্তি নেই কিন্তু সব অশ্রুই যেমন বেদনা নয় তেমন সব অন্ধকারকেই লোডশেডিং বলে চালিয়ে দেওয়ার আমাদের যে চালু অভ্যেস তাতে ঘোরতর আপত্তি আছে। কেন? না অনেকগুলো কারণেই এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ কিছুক্ষণ বা দীর্ঘক্ষণ বন্ধ থাকতে পারে যেমন মেরামতি, যেমন তার ছিঁড়ে যাওয়া বা কোনও বড় গলদ ইত্যাদি, এগুলোর কোনওটাই লোডশেডিংয়ের আওতায় পড়ে না, সাধারণ ইংরেজিতে এদের বলা যেতে পারে ‘শাট ডাউন’। তাহলে লোডশেডিং কাকে বলব? উত্তরটা লুকিয়ে আছে নামের মধ্যেই, লোড এবং শেডিং, গোদা বাংলায় বললে ‘বোঝা ঝেড়ে ফেলা’। যখন এমন অবস্থা হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যায় যে, বিদ্যুতের চাহিদা তার জোগানের চেয়ে বেড়ে যেতে পারে তখন চাহিদা ও জোগানের মধ্যে সামঞ্জস্য রাখার জন্য সুপরিকল্পিতভাবে কিছু কিছু জায়গায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়, একেই বলা হয় লোডশেডিং, অর্থাৎ লোডশেডিং হচ্ছে একেবারেই বিদ্যুৎ বণ্টন বিভাগের ইচ্ছাকৃত এবং সুপরিকল্পিতভাবে কোনও কোনও গ্রাহকের কাছে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখার নাম। এক্ষেত্রে উদ্দেশ্য, যে সমস্ত গ্রাহকের কাছে বিদ্যুৎ অপরিহার্য তাঁদের বিদ্যুৎ সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখা যেমন, হাসপাতাল, সামরিক প্রতিষ্ঠান, গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক দপ্তর, শিল্পপ্রতিষ্ঠান, এয়ারপোর্ট, রেলস্টেশন ইত্যাদি। যাঁদের ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ অপেক্ষাকৃত কম প্রয়োজনীয় মানে আমাদের মতো সাধারণ গেরস্ত গ্রাহক স্বাভাবিকভাবেই লোডশেডিংয়ের ভুক্তভোগী হন তাঁরাই। ব্যাপারটা বলা যত সহজ বাস্তবে সেটা রূপায়িত করার জন্য যথেষ্ট দক্ষতা এবং সাবধানতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। লোডশেডিংয়ে ভুলচুক হলে বিস্তর গণ্ডগোল হতে পারে।

দেশের তথা রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে যে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলো আছে তারা যে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে তা হচ্ছে অলটারনেটিং কারেন্ট অর্থাৎ যে বিদ্যুতের পরিমাণ এবং অভিমুখ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চক্রাকারে বা তরঙ্গের মতো পালটায়, কারণ সেই রকম বিদ্যুৎই খুব সহজে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় সরবরাহ করা যায় এবং সহজেই তার ভোল্টেজ ট্রান্সফর্মারের সাহায্যে বাড়ানো বা কমানো যায়। অলটারনেটিং কারেন্টের অভিমুখ কত দ্রুত পালটায় তা নির্ভর করে সেই বিদ্যুতের কম্পাঙ্ক বা ফ্রিকোয়েন্সির উপর। আমাদের সমস্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলি এবং সরবরাহের লাইনগুলি পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে একটা বিদ্যুতের জাল যাকে বলা হয় পাওয়ার গ্রিড তার মাধ্যমে যুক্ত, ফলে তাদের সবার ফ্রিকোয়েন্সিই একটা নির্দিষ্ট মাপে বাঁধা এবং তা হচ্ছে ফিফটি হার্জ যেখানে হার্জ হচ্ছে কম্পাঙ্কের একক, এবং সেই মতো দেশের সমস্ত বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম বা অ্যাপ্লায়েন্সগুলো ফিফটি হার্জ এই কম্পাঙ্কে কাজ করার জন্যই প্রস্তুত করা হয়। এবার কোথাও বিদ্যুতের চাহিদা যদি বিদ্যুতের জোগানের চেয়ে বেশি হয়ে যায় তাহলে সেই অঞ্চলে সরবরাহ লাইনের ফ্রিকোয়েন্সি কমে যেতে পারে, জাল যতই বড় হোক না কেন তার কোনও প্রান্তে বা কোথাও সামান্য একটা ফুটো যেমন সমস্ত জালটাকে অকেজো করে দিতে পারে ঠিক সেরকম কোনও অঞ্চলের ফ্রিকোয়েন্সি কমে গেলে বিস্তীর্ণ অঞ্চলের বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা পুরোপুরি ব্যাহত হয়ে আপৎকালীন অবস্থার সৃষ্টি করতে পারে আর সেটা যাতে না হয় তাই আগাম সর্বত্র বিদ্যুতের চাহিদা সঠিকভাবে নির্ধারণ করে দেখে তা যদি জোগানের চেয়ে বেশি হয় তাহলে যেখানে বিদ্যুৎ বন্ধ রাখলেও বড় কোনও বিপদ বা ঝুঁকির প্রশ্ন নেই সেখানে বিদ্যুৎ বন্ধ রাখা হয়। তাহলে বোঝাই যাচ্ছে লোডশেডিং ব্যাপারটার মধ্যে যতই অন্ধকার থাক আসলে তা করা হচ্ছে আলোর ব্যবস্থাকে সচল রাখারই জন্যই।

আগে ঘনঘন লোডশেডিং হত কারণটা সহজেই অনুমেয়, বিদ্যুতের চাহিদার তুলনায় জোগান কম ছিল। পরে দেশে এবং রাজ্যে অনেক নতুন বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে, রাজ্যে যেমন সাগরদিঘি, বক্রেশ্বর, ভারত আর ভুটানের যৌথ উদ্যোগে চুখা ইত্যাদি বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্রগুলো বিদ্যুতের জোগান অনেক বাড়িয়েছে। এছাড়াও পুরোনো যে পাওয়ার প্ল্যান্টগুলো ছিল তাদেরও উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে, ফলে আজকে বাড়িতে বাড়িতে বিদ্যুতের চাহিদা অনেক বাড়লেও জোগান তার চেয়েও অনেক বেশি বেড়েছে। আজকে ইচ্ছে করে বিদ্যুৎ বন্ধ রাখার প্রয়োজন ফুরিয়েছে। সেইসঙ্গে ফুরিয়ে গেছে পাড়ায় পাড়ায় জনতা বা তাদের প্রবল প্রতাপশালী প্রতিনিধিদের সঙ্গে বিদ্যুৎ দপ্তরের কর্মচারী বা আধিকারিকদের তুমুল সংঘাত বা বাদানুবাদের গরম গল্প, ফুরিয়ে গেছে সেই সমস্ত অভূতপূর্ব কথোপকথন, ফোনালাপ, যখন প্রবল গ্রীষ্মের রাতে ঘুরত না ফ্যান, টিভিতেও বন্ধ গুরুত্বপূর্ণ ভারত–পাকিস্তান ওয়ান ডে, বা সিরিয়ালের বহু প্রতীক্ষিত এপিসোড, যখন পাশের পাড়ায় বা রাস্তার ওপারে কিন্তু দিব্যি জ্বলছে আলো।

এসব অভিজ্ঞতা কমবেশি আমাদের প্রত্যেকের আছে। সেসব বিস্তারিত লিখতে গেলে মহাভারত। গরমকালেই বিদ্যুতের চাহিদা উঠত তুঙ্গে, ফলে ভুক্তভোগীদের মাথা গরম। কারণ আমরা সবাই তো আর জুলফিকর হকের মতো নির্ভেজাল দার্শনিক না! কিন্তু দপ্তরের আধিকারিকদের মাথা রাখতে হত এস্কিমোদের মতো ঠান্ডা। শুধু ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বিদ্যায় তা কুলাত না, প্রয়োগ করতে হত জনতার মনস্তত্ত্ব বোঝার নানান কূটকৌশল। যেমন একবার হাঁসফাঁস করা গরমের নিকষ অন্ধকারে ফোন আসে সাব-স্টেশনে, ‘কী ব্যাপার দাদা, আলো কখন আসবে?’ গল্প করছিলেন বহু সাব-স্টেশনে দায়িত্ব সামলানো সদ্য প্রাক্তন রসিক বিদ্যুৎ আধিকারিক, ‘ফোনের ওপার থেকে শুনতে পাচ্ছি কারা সব বলাবলি করছে, এই হাত লাগাবি না, হাত পেছনে রাখ, আর একটা কাঠি জ্বালা না শিগগির এটা নিভে যাচ্ছে, কেউ একজন বলছে দেশলাই তো ফুরিয়ে আসছে আর তিন-চারটা কাঠি মাত্র পড়ে আছে… কিছুক্ষণ পরে ব্যাপারটা বোঝা গেল ব্যাটারা সব জুয়া খেলছিল গাছের তলায়, আলোর নীচে, রাস্তার ধারে, হঠাৎ অন্ধকারে তাস, বোর্ডের অনেক টাকা সব ওলট-পালট হয়ে যাওয়ার জোগাড়… তাই দপ্তরে ফোন, তিন-চারটে কাঠি জ্বলতে জ্বলতে আলো আনার ব্যবস্থা করা যায় কি না…’।

যেবার যুবরাজ ছয় বলে ছ’টা ছক্কা মেরেছিলেন সেবার উত্তরবঙ্গের এক গোটা মফফসল শহর লোডশেডিংয়ের ফেরে ভারতের ব্যাটিংই দেখতে পায়নি, ফলে সাব-স্টেশনের অবস্থাটা কী হয়েছিল অনুমান করাই যায়। কীভাবে সাব-স্টেশনের কর্মীরা সামলেছিলেন সেই রাত সে অন্য গল্প। এমন গল্প অগুনতি জমে আছে বিদ্যুৎ দপ্তরের কর্মীদের অভিজ্ঞতার ঝুলিতে। কোথায় কতক্ষণ লোডশেডিং হবে তা ঠিক করা হয় কেন্দ্রীয়ভাবে সেন্ট্রাল লোড ডেসপ্যাচ সেন্টার থেকে, আমাদের রাজ্যে তার ঠিকানা হাওড়া। সেখান থেকে নির্দেশ আসে এবং তা কার্যকর করার দায়িত্বে থাকে সংশ্লিষ্ট সাব-স্টেশনগুলো। কাজটা নিঃসন্দেহে চ্যালেঞ্জিং।
আজকেও কখনো-সখনো অল্পবিস্তর লোডশেডিং হয় বটে কিন্তু ইনভার্টারের কল্যাণে আমরা হয়তো বুঝতেই পারি না আর ক্রিকেট সিরিয়াল দেখার জন্য তো কেউই টিভির উপর ইদানীং নির্ভর করে না মুঠোয় মোবাইল আছে, বিছানায় ট্যাব।



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *