অন্দরমহলের মহাজাগতিক রূপকথা 

অন্দরমহলের মহাজাগতিক রূপকথা 

শিক্ষা
Spread the love


 

  • রুমি বাগচী

লস অ্যাঞ্জেলেসে আমার বাড়ি থেকে হলিউড যাব হয়তো। ঠিক বাইশ মিনিট পর ডানদিকে নাসা জেট প্রপালসন ল্যাবরেটরি। তা ছেড়ে আরও দশ মিনিট সামনে যেতে হয়। কিন্তু সেদিন আমি ডানদিকেই মোড় নিলাম।

সান গাব্রিয়েল পর্বতমালার গায়ে দাঁড়িয়ে আছে সেই লম্বা বিল্ডিংগুলো, যেখান থেকে তেষট্টি বছর আগে পৃথিবী ছাড়িয়ে মহাকাশের রহস্যময়তার দিকে মানুষ হাত বাড়িয়েছে।

যেদিন প্রথম আকাশের দিকে চোখ তুলে তাকিয়েছিলাম, সেদিন থেকেই নাসার কথা জানি। তাই জানি, এর ভেতরে ঢুকলে এক মুহূর্তে আমার জীবনদর্শন পালটে যাবে। যখন সত্যিকারের মহাকাশযান দেখব। আকাশছোঁয়া নয়, মানুষের মহাকাশছোঁয়া কৃতিত্ব দেখে শিহরিত হব। আর পৃথিবীকে এই মহাবিশ্বের মাঝে এই প্রথম ভীষণ ছোট্ট মনে হবে।

আগে থেকে রিজার্ভেশন করলে সাধারণ মানুষ ঘুরে দেখতে পারে। আমাদের গাইড এখানকারই এক ইঞ্জিনিয়ার। প্রথম স্টপ “মিশন কন্ট্রোল”। যেখানে একটি বিশাল আমেরিকান পতাকা ঝুলছে।

সাদা দেওয়াল আর নীল কার্পেটের এই ঘরই কোটি কোটি মাইল দূরের মঙ্গল গ্রহের রোভার, ভয়েজারের মতো সব মহাকাশযানের সঙ্গে টেলিমেট্রি ডেটা ব্যবহার করে যোগাযোগ রাখে। মহাকাশচারীদের সারাক্ষণ নির্দেশ দেয়, কী কী করতে হবে। কোনও সমস্যা হলে সেই মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিয়ে সমাধান করতে হয়।

এই ঘরেই রোমাঞ্চকর একটি জিনিস দেখলাম– লাইট ওয়াল। এক সারি আলোর বিন্দু। একটি বিন্দু দপদপ করে ওঠার মানে মহাশূন্যে কোনও মহাকাশযান এখন নাসার সঙ্গে কথা বলছে। এর পর আমাদের চোখ বন্ধ করে যেখানে নিয়ে গেল, সেখানে চোখ খুলে দেখি বিস্ময় থামে না। আমরা মঙ্গল গ্রহের লাল রুক্ষ্ম মাটি আর লাল পাথরের মাঝে দাঁড়িয়ে।  মঙ্গল গ্রহের অনুকরণে এটি বানানো হয়েছিল। রোভার পাঠানোর আগে এখানে চালিয়ে প্র্যাকটিস করা হত। অসামান্য দৃশ্য।

সেই রোভার এখনও মঙ্গল গ্রহে ঘুরে ঘুরে নানা ভূতাত্ত্বিক তথ্য পাঠায়। তাই আমরা জানি, মঙ্গল গ্রহ ঠান্ডা। ধুলোময় মরুভূমির মতো একটি জায়গা হলেও অতীতে সেখানে জল ছিল।

এবার যেখানে এলাম সেটাই নাসার মস্তিষ্ক। একদম মহাকাশের পরিবেশ। সেই সাদা মোটা মোটা পোশাক পরা মেধাবী বিজ্ঞানীরা বড় কাচের জানলার ওপাশে মহাকাশযান তৈরিতে ব্যস্ত। বিজ্ঞানীদের সঙ্গে আছেন বাঘা বাঘা ইঞ্জিনিয়ার আর  মিশন লিডার।

কোন পর্যায়ের অঙ্ক  এবং পদার্থবিদ্যা জানতে হয়, এসব করার জন্য? ছুঁতেও পারি না সেসব। অবিশ্বাস্য লাগে। এখানকার প্রত্যেকটি বিজ্ঞানীও যেন মহাজাগতিক। অন্তত আমি যে মানুষ, সেই একই মানুষ এঁরা কিছুতেই নন। অন্য কোনও জগতের মানুষ।

শুনলাম, একটি ধুলোকণাও এই কোটি কোটি অর্থমূল্যের মিশনকে খারাপ করে দিতে পারে। তাই ওই কাচের দেওয়াল।

আরও একটি দারুণ জিনিস এখানেই। একটি দেওয়ালে অজস্র চিরকুট। যাদের বিশ্বের সবচেয়ে দামি চিরকুট বলা হয়। কেন? বিভিন্ন মিশনে যাওয়ার আগে লাস্ট মিনিট মিটিংয়ে কোনও আইডিয়া এলে যেসব চিরকুটে লেখা হয়েছে।

এবার ভিজিটর সেন্টার। যেখানে মানবসভ্যতার চোখধাঁধানো কিছু মাইলস্টোন রাখা। ভয়েজার, ক্যাসিনি, জুনোর মতো বিখ্যাত মিশনের নানা মডেল। নাসা কী কী কর্মকাণ্ড করেছে, তা আমরা কতটুকুই বা মনে রাখি! এখানে এলে মনে পড়ে।

ভয়েজার একমাত্র মহাকাশযান, যা আজ পর্যন্ত সবচেয়ে দূরে আমাদের সোলার সিস্টেমকেও ছাড়িয়ে চলে গেছে। কোটি কোটি মাইল দূরে  নক্ষত্রমণ্ডলে পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে একটি গোল্ডেন ডিস্ক সঙ্গে নিয়ে গাঢ় অন্ধকারে আজও একা ঘুরছে।

কী আছে সেই ডিস্কে? পৃথিবীর প্রাকৃতিক কিছু শব্দ, যেমন পাখির শিস, বজ্র ধ্বনি, ঝরনার শব্দ আর নানা দেশের মিউজিক। আর আছে পঞ্চান্নটা ভাষায় শুভেচ্ছাবার্তা। যেখানে সব দেশের পরিচয় মুছে গিয়ে আমরা শুধুই পৃথিবীবাসী।

যদি মহাকাশের কোথাও, কোনও গ্রহে কোনও বহির্জাগতিক প্রাণী থাকে, তবে মহাবিশ্বের অসীম নিস্তব্ধতায় এটি-ই হবে তাঁদের প্রতি আমাদের প্রথম উচ্চারণ। যদি কেউ সত্যি থাকে, তবে সে যেন পৃথিবীর নানা রঙের শব্দগুলো শুনে আমাদের প্রতি আগ্রহী হয়!

ক্যাসিনি ও জুনো কী করছে?

ক্যাসিনি তেরো বছর ধরে শনির চারপাশে ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করেছে।  জুনো জুপিটারের  চারপাশে এখনও ঘুরে ঘুরে নানা তথ্য পাঠিয়ে যাচ্ছে। জুপিটারের আকাশে জুনোর পৌঁছাতে পাঁচ বছর সময় লেগেছিল। তাহলে পৃথিবী থেকে জুপিটার কত দূরে? পঞ্চাশ কোটি মাইল।

আমার জীবনে সবচেয়ে বড় ও নিষ্ঠুর দূরত্ব ভারত থেকে আমেরিকার।  মঙ্গল গ্রহ, জুপিটার, শনির মিলিয়ন বিলিয়ন মাইলের এই দূরত্ব আমার অনুভবেই আসে না।  সুনীতা উইলিয়ামস ও বুচ উইলমোরের স্পেস স্টেশন অবশ্য তুলনায় পৃথিবীর কাছাকাছিই ছিল।

এ ঘরে একটি লুনার মডেলও আছে। যদিও ‘অ্যাপেলো ইলেভেন’ ফ্লোরিডার নাসারই কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে যাত্রা করেছিল।

আমরা গুগল করে সহজেই জানি যে কোন কোন দেশ এ পর্যন্ত চাঁদে গিয়েছে ! আমেরিকা, রাশিয়া, চিন, ভারত ও জাপান।  চাঁদে গিয়েছে মানে কিন্তু শেষ চারটে দেশ শুধুমাত্র মহাকাশযান পাঠিয়েছে।  কেউ আজও  মানুষ পাঠাতে পারেনি।

একমাত্র আমেরিকা চাঁদে মানুষ পাঠিয়ে আবার তাঁদের সুস্থ অবস্থায় ফিরিয়েও এনেছে। চাঁদের মাটিতে হেঁটেচলে বেরিয়েছেন মহাকাশচারীরা। তাও সেটি কত বছর আগে? পঞ্চান্ন বছর আগে।  শুধু ভাবুন একবার।

নাসার চাঁদে অবতরণ আমাকে বিস্মিত করে। এরপর আরও ছ’বার নাসা  চাঁদে মানুষ পাঠিয়েছে এবং মোট বারোজন মহাকাশচারী চাঁদের মাটিতে হেঁটেছেন।  আর অন্য দেশের মতো মহাকাশযান? অগুনতি বার। পঞ্চান্ন বছর কেটে গিয়েছে, কেউ আজও চাঁদে মানুষ পাঠাতে পারেনি।  আমাদের মতো সাধারণ মানুষের বোঝার জন্য এই হচ্ছে নাসা।

নাসা কিন্তু শুধু আমেরিকানদের নিয়ে গুটিয়ে  থাকেনি। নানা দেশের বহু মেধাবী মানুষ একসঙ্গে তাঁদের মস্তিষ্ক ও হৃদয় দিয়ে এখানে কাজ করেন।

একটি ছোট্ট মানুষ কী করে এত দূর পর্যন্ত তাঁর অস্তিত্ব ছড়াতে পারেন! কী করে এই প্রকাণ্ড ও জটিল সব মহাকাশযান বানান! অথচ তাঁর গায়ে শক্তি কতটুকু? শুধু ওই ছোট্ট মাথায় এত কিছু?

যখন বেরিয়ে এলাম, মনে হল আজ থেকে আমিও আরেকটু বড় করে সব ভাবব। আরও দূরে, বহুদূরে কোথাও বেড়াতে যাব। যতটুকু পারি। কখনও দূরত্বই ভীষণ আকর্ষণীয়।

(লেখক লস অ্যাঞ্জেলেসের বাসিন্দা শিলিগুড়ির ভূমিকন্যা)



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *