- জয়দেব সাহা
সপ্তাহে একটা দিন অনন্তপুরে হাট বসে। অনন্তপুর ঠিক কোথায়? সে আমাদের খুব চেনা কোনও একটা গ্রাম অথবা শহরতলি। এই হাটেই প্রতি সপ্তাহে দোকান নিয়ে বসেন ষাটোর্ধ্ব একজন মানুষ। এত ভিড়ের মধ্যেও বড্ড নিঃসঙ্গ তিনি। জিজ্ঞেস করলে জানা যাবে, তাঁর সঙ্গে যাঁরা আগে হাট করতেন, তাঁদের কেউই আর আসেন না। এসেছে একঝাঁক নতুন মুখ। নতুন মুখগুলোর সঙ্গে নতুন পরিচয় হয়েছে ঠিকই, কিন্তু বয়সের পার্থক্য হয়তো এই পরিচয়কে সাবলীল হতে দেয় না। ষাটোর্ধ্ব মানুষটা দেখেছে এই গ্রামীণ হাটের বিবর্তন। একটা সময় সকাল থেকেই ভিড় উপচে পড়ত দোকানে। সে কত যুগ পুরোনো গল্প! সময়ের সঙ্গে এই রূপরেখাটি বদলে গেছে। ঠিক যেমন পুরোনো মানুষগুলো আর নেই, তেমনই নেই পুরোনো সেই মানুষের ভিড়।
গ্রাম অথবা শহরতলির হাটগুলো আজ ঠিক কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে? প্রশ্নটা বড্ড কঠিন। হাট এখনও জীবন্ত এক দলিল, কিন্তু হারিয়ে যাওয়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে না কি? একটা সময় এই হাটগুলো ছিল ব্যবসার অন্যতম প্রধান জায়গা। গ্রাম আর শহরতলিগুলো সপ্তাহে একদিন অথবা দু’দিন মেতে উঠত মানুষের ভিড়ে। আশপাশের লোকালয় থেকেও মানুষ ভিড় জমাত কেনাকাটার জন্য। এই ভিড়েই কত মানুষের দেখাসাক্ষাৎ হত পরিচিত মানুষজনদের সঙ্গে। ঠিক অনেকটা মেলার মতো।
সময় তো পরিবর্তনের গল্প লিখতে ভালোবাসে। পরিবর্তনের এই স্রোতে আসতে আসতে গ্রামগঞ্জেই গড়ে উঠল ছোটখাটো বাজার। গজিয়ে উঠল অনেক দোকানপাট। মানুষ সহজেই পেয়ে গেল নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। সুতরাং হাটের উপর নির্ভরশীলতা কমে আসল। কিন্তু এসবের মধ্যেও একেবারে ধসে যায়নি হাট ব্যবস্থা। তবে তার ব্যাপ্তি তো কমেছেই অনেকটা। এরপর আসল অনলাইন অর্ডার আর বিশাল মলের যুগ। প্রথমে শহরে এই মলগুলো গজিয়ে উঠলেও আসতে আসতে সেগুলো ছড়িয়ে পড়ল শহরতলিতেও। প্রয়োজনীয় প্রায় সমস্ত কিছুই পাওয়া যায় এই ঠান্ডা ঘরের মলগুলোতে।
মানুষের স্রোত এবার বেঁকে বসল হাটের অভিমুখ থেকে। এর সঙ্গে যখন প্রায় সবই অনলাইনে অর্ডার করলেই ঘরে পৌঁছে যাচ্ছে, মানুষ কেন দৌড়াবে মাইল পেরিয়ে হাটের দিকে। হাটের ভিড় এভাবেই কমতে কমতে হয়ে এসেছে বড্ড বেমানান। পুরোনো জৌলুস হারিয়ে সে হয়তো এখন দিন গুনছে, কোন এক বসন্ত পেরোলে বিদায়ঘণ্টা বাজবে তারও। ওই যে, সময় পরিবর্তনের গল্প লিখতে ভালোবাসে।
অনেক শহরের লাগোয়া এলাকায় হাট এখনও আছে। সেটা হাট না বলে বাজার বলাই ভালো। এখনও অনেক গ্রামগঞ্জে হাট বসে। জৌলুস কমলেও বসে তো। মানুষ আজও ভিড় জমায়। হয়তো এই ভিড়টা কমে এসেছে, তবু টিকে আছে কোনওভাবে। অনেক দোকানদার আজও হাটকে কেন্দ্র করে সংসার চালান। কিন্তু এবার হয়তো বিকল্প খুঁজতে শুরু করছেন তাঁরাও। যে ষাটোর্ধ্ব মানুষটা আজও নিঃসঙ্গ হলেও হাটে বসেন, তিনি হয়তো ক’বছর পর আর আসবেন না। এভাবেই পুরোনো দলিলগুলো মুখ ফেরাবে হাট ব্যবস্থা থেকে। সময়ের স্রোতে দোকানিরা এক এক করে গুটিয়ে নেবে নিজেদের দোকান। অতীতের পাতায় লেখা থাকবে একটা ব্যবস্থার ইতিহাস। সময় গল্প লিখবে আরেকটা পরিবর্তনের ধারার।
(লেখক মালদার সামসীর বাসিন্দা। পাটনা আইআইটি রিসার্চ স্কলার)