অকারণ লজ্জা নেই পোশাকে, আচরণে

অকারণ লজ্জা নেই পোশাকে, আচরণে

শিক্ষা
Spread the love


 

  • সুমনা ঘোষদস্তিদার

দু’চোখের জল নরম গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে ছোট্ট মেয়েটি। দু’পাশে মাথা নাড়িয়ে বলছে, ‘আর কখনও স্কুলে পুতুল নিয়ে আসব না। এবার ওকে দিয়ে দাও।’ দিদিমণি কপট রাগ দেখিয়ে গম্ভীর গলায় বলেন,  ‘আর যেন না দেখি কখনও।’

ঠাকুমার সাদা কাপড় ছিঁড়ে তৈরি পুতুল, কাঠিতে সুতো পেঁচিয়ে হাত-পা বানিয়ে কালো সুতোয় চোখ আর লাল সুতোয় সেলাই করে ঠোঁট বানিয়ে দিয়েছেন মা। কালই তো পাশের বাড়ির বন্ধুর পুতুলের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে ওর বড় পুতুলের। দিদিমণি পুতুল ফিরিয়ে দিলে, দৌড়ে স্কুলের বই নেওয়ার স্টিলের বাক্সে পুতুলকে শুইয়ে দিল বই পেন্সিলের পাশে। স্কুলে মেয়েরা পরিপাটি করে টিফিন নিয়ে আসে। সে বাক্সে কখনও হাত গড়া রুটি, পরোটা, পেটে জেলি ভরা বিস্কুট, পাউরুটি কলা। স্কুল শেষে পাড়ার দিদিদের হাত ধরে হেঁটে বাড়ি ফেরা, কখনও কাঠি বরফ বা হজমি, ঢপের নাড়ু খেতে খেতে।

স্কুল ছুটির পর কেউ বাড়ি ফেরে রিকশায়, কেউ দাদা, কাকা, বাবার সাইকেলে চেপে। বাড়ির সদর দরজায় অপেক্ষায় থাকতেন দাদু। কয়লার উনুনে কড়াই বসিয়ে হলুদ মাখা হাত আটপৌরে শাড়ির আঁচলে মুছতে মুছতে মায়ের বকুনি আর মারের হাত থেকে বাঁচতে জেঠিমা, ঠাকুমার পেছনে লুকনো।

যৌথ পরিবারের এ এক পরিচিত ছবি। নতুন বৌদির ওড়না পেঁচিয়ে শাড়ি পরা আর গামছা মাথায় বেঁধে খোঁপা করা, ইটের গুঁড়োয় রান্নার মশলা বানানো, লুচিপাতা, পুঁইশাকের বীজ জলে গুলে ঝোল, এসব খেলার জোগানদারও ওই কম বয়সি কাকিমা, বৌদিরাই থাকতেন। দুপুরে গড়িয়ে নেবার আগে পাড়ার মহিলাদের আম, চালতা, কুলমাখা খাবার, সঙ্গে সঙ্গে ঝড়ের গতিতে হাত চলত উলকাঁটা, কুরুশ বা চটের ওপর রংবেরঙের সুতো দিয়ে বিভিন্ন নকশা তোলায়। কারও হাতে প্রিয় লেখকের বই। বিকেলে পাড়ার মাঠে সব ছোট ছেলেমেয়েদের একসঙ্গে হাডুডু, এক্কাদোক্কা, কুমিরডাঙ্গা, গোলাপ টগর খেলা।

খেলা শেষ হলে নিয়ম করে নাচ, গানের রেওয়াজ, তারপর পড়তে বসা। সপ্তাহে তিন বা চারদিন আসতেন গৃহশিক্ষক। তখন থেকেই মেয়েটি জানত ভবিষ্যতে কোন কোন বিষয় নিয়ে মেয়েদের পড়া সুবিধা এবং উচিত।  প্রতিটি বিষয়ই পড়াতেন তিনি। লোডশেডিংয়ে পড়া চলত হ্যারিকেন, লন্ঠন সঙ্গে তালপাতার পাখার ঠান্ডা বাতাসে। পরনে থাকত সুতির ছিটের কাপড়ের  ঘটি হাতা, কুঁচি দেওয়া জামা, শীতে মা, কাকিমার বানানো সোয়েটার, টুপি, মাফলার। মেঝেতে আসন পেতে, কখনও টেবিলে পরিবারের সকলে একসঙ্গে খাওয়া শেষ হলে, বিছানায় মায়ের শরীর বোরোলিন, তুহিনা, মাথায় জবাকুসুমের এক অদ্ভুত সুগন্ধে ভরে থাকত। ক্লান্ত মা ঘুমিয়ে পড়লে টর্চ জ্বালিয়ে চুপিচুপি গল্পের বই পড়া, যে গল্প বা উপন্যাস পড়ায় নিষেধ ছিল, নাগালের বাইরে ছিল, তার প্রতি আকর্ষণ বেশিই থাকত।

আর লম্বা ছুটি পড়লে মামা, মাসিদের বাড়ি। দুপুরে মেয়েরা পাড়ার এবাড়ি ওবাড়ি থেকে চাল, ডাল, তেল, নুন জোগাড় করত,  চেয়ে আনত কড়াই, খুন্তি। ইট পেতে তৈরি উনুনে শুকনো গাছের ডাল জ্বেলে চড়ুইভাতি। আর বিশেষ বিশেষ দিনে পয়লা বৈশাখ, পুজো বা রবীন্দ্রজয়ন্তীতে মায়েদের শাড়ি তিনদিক বেঁধে, চৌকি পেতে তৈরি হত মঞ্চ, তাতেই চলত বিভিন্ন অনুষ্ঠান। এমন সব অনুষ্ঠান বা পুজোয় মেয়েদের সাজ বলতে শাড়ি, সুতোর লেস লাগানো  পেটিকোট, ফোল্ডেড, বেল, পফ, বাটারফ্লাই, রাফেল হাতার ব্লাউজ। তাঁত, পিওর সিল্ক, সাউথ সিল্ক আর ছাপা শাড়ির চল ছিল বেশি। ঘরে পাতা কাজল, গুঁড়ো টিপ বা সিঁদুর আর হালকা লিপস্টিক। চুলে লম্বা বেণি বা বাহারি খোঁপায় গোঁজা সোনা-রুপোর গোলাপ কাঁটা। সামনের চুল অদ্ভুত কায়দায় হাতের আলতো চাপে এক ভাঁজ তৈরি করে ফুলিয়ে নিতেন। শাড়ির রঙের সঙ্গে মিলিয়ে নিতেন বটুয়া বা ব্যাগ।

অল্পবয়সি মেয়েদের পোশাকে বেশ গালভরা নাম ছিল। সারারা, সালোয়ার কামিজ, চুড়িদার, বেল বটম প্যান্ট, ঘাগড়া, ম্যাক্সি, স্কার্ট, মিডি। মায়ের কৌটো থেকে মাখা হত স্নো, ক্রিম, পাউডার, কাজল, লিপস্টিক। খুব বেশি হলে তিনখানা চটি, জুতো থাকত, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তাই দিয়েই সাজ সম্পূর্ণ হত।

এরই মাঝে এক সময় প্রেম আসত চুপিসারে, খুব গোপনে। সবার চোখ এড়িয়ে একটু ছোঁয়া, একটু দেখা, সে যেন তপস্যার মতো। কোন রাস্তায় গেলে বড়দের চোখ এড়িয়ে যাওয়া যাবে সে হিসেব করে তবেই যাওয়া। চিঠির বুকে একবিন্দু আতর ছিটিয়ে তাকে দেওয়া, একটা গোলাপ বা একটা চটি বই উপহার, এটুকুই ছিল ‘ভালোবাসি’ বোঝানোর উপায়। আর বিয়ের ক্ষেত্রে পরিবারের ঠিক করা পাত্র বা প্রেমিকটি যখন স্বামী হতেন তখন একটি মাত্রই মন্ত্র জানা  ছিল ‘সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে।’ অতএব ভালোবাসা, সম্পর্ক, শান্তি বা বিশ্বাসে সংসার  টিকিয়ে রাখার দায় নারীর উপরেই বর্তায়। পরিবার পরিকল্পনার ক্ষেত্রেও নারীর সম্মতি কিছুটা আলগাই থাকত, তবুও তারা যৌথ পরিবারে বেঁধে বেঁধে থাকতেন, আনন্দে বাঁচতেন।

এ ছবি পালটে গেছে, পালটে যায় দিনে দিনে। টেডি বুকে চেপে নাইট ড্রেস পরা ঘুমন্ত বাচ্চাকে ডেকে স্কুলের জন্য তৈরি করে পুলকারে তুলে দেন মা। স্লেট, দোয়াত, কালির পেন হারিয়ে গেছে, তাদের হাতে নিত্যনতুন পেন, পেন্সিল, রকমারি পেন্সিলবক্স আর জলের বোতল। এক স্কুলব্যাগ বেশিদিন ব্যবহারেও নারাজ তারা। টিফিন বক্সে মুড়ি, রুটি, ঘুগনির জায়গায় এসেছে স্যান্ডউইচ, ম্যাগি, পাস্তা, ফ্রুটস স্যালাড, এগ চিকেন রোল আরও কত কী! নিউক্লিয়ার পরিবার। বাড়ি ফিরে মেয়ের একলা ঘর, আয়ামাসির পাহারায়। কর্মস্থল থেকে মা মাঝেমধ্যেই চোখ রাখেন সিসি ক্যামেরায়। একাকী মেয়ে নিজের মনে থাকে, ডল হাউস, বার্বি বা মনের মতো বই, মোবাইলে খেলা নিয়ে।

এমন একা থাকায় কত মনের রোগের শিকার আজ তারা। আর যে মেয়েটি বয়ঃসন্ধির দোরগোড়ায় তার ইচ্ছে, ভাবনা, অনুভূতি পালটে যায় দিনে দিনে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নবম শ্রেণিতেই আর শাড়ি নয়, স্কার্ট শার্ট টাই আর শু-তে স্মার্ট মেয়ে, স্মার্ট তারা মনেও। অকারণ লজ্জা নেই পোশাকে, আচরণে। ক্রপ টপ, শর্ট ড্রেস, শর্টস, লেহেঙ্গা, কোয়ার্ড সেট, প্লাজো সবেতেই সচ্ছন্দ ওরা। চুলকেও সাজায় ভিন্ন ভিন্ন রঙে, হাইলাইট আর বিভিন্ন কাটে। চোখ, নাক, ঠোঁটের খুঁত ঢাকতে হরেক প্রসাধনী, কিছু ক্ষেত্রে রূপ বিশেষজ্ঞ এবং চিকিৎসকরাও সাহায্য করেন। আর প্রেমে বা বন্ধুত্বেও তারা যথেষ্ট সাহসী। কেবল সিনেমা হল, শপিং মল বা রেস্তোরাঁয় নয়, রাস্তার ঠেকে, পাবেও তাদের অবাধ যাতায়াত। বন্ধুত্বে বা প্রেমে কেবল আবেগে ভেসে চলাই নয়, বর্তমান আর ভবিষ্যৎ বুঝে চলা আর মতের অমিলে, অসম্মানে বা নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে বাধা হয়ে দাঁড়ালে অনেক ভালোবাসাকেই ছেড়ে যেতে প্রস্তুত তারা, সে প্রেমিক বা স্বামী যে সম্পর্কেই থাকুক।

এখন আর পেশার ক্ষেত্রেও লিঙ্গ পরিচয়কে আলাদা করে দাগিয়ে দেওয়া যায় না। তাই এখন তাদের বিয়ের ভাবনার আগে এসেছে চাকরির ভাবনা। যাদের ক্ষেত্রে চাকরির সুযোগ মেলেনি আর অপেক্ষা না করে, তাদের এখন ছাত্র পড়াতে, সেলাই মেশিন চালাতে, বিউটি পার্লার বা ফাস্টফুডের দোকান দিয়ে, আরও কত শত অভিনব পেশায় যুক্ত হতে দেখা যায়। স্বাবলম্বী হয়ে মেয়েরা নাকি স্বাধীনচেতা হয়েছে, লজ্জা, ভয় ভেসে গেছে সব, ছেলেদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে তারা।

হয়তো তাই, হয়তো বা তাই নয়, আজ  তো নারী মহাকাশ থেকে প্রদীপ জ্বালা মাটির ঘরে, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে দুধের শিশু পিঠেবেঁধে চা বাগিচায়,  শিক্ষক থেকে সুন্দরী প্রতিযোগিতায় র‍্যাম্পে হেঁটে যান। জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে ঘর আর বাইরেকে  বুদ্ধি, ভালোবাসা আর শ্রম দিয়ে বাঁধতে শিখেছে, বাঁধতে পেরেছে। প্রতিবাদের ভাষা পেয়েছে, প্রাপ্যটুকু আদায়ের শক্তি পেয়েছে, শক্ত মাটিতে পা রেখে বাঁচতে শিখেছে। তবুও অনেক কিছু পাবার বাকি, আদায়ের বাকি, অন্যায়ের শাস্তি বাকি রয়ে গেছে এখনও। আরও অনেক পথ  চলা বাকি, এগিয়ে যাওয়া বাকি নারীর।

(লেখক জলপাইগুড়ির বাসিন্দা। শিক্ষক)



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *