‘আ মরি বাংলা ভাষা’ এখন বিপদ ভিনরাজ্যে

‘আ মরি বাংলা ভাষা’ এখন বিপদ ভিনরাজ্যে

শিক্ষা
Spread the love


 

মোদের গরব মোদের আশা/ আ মরি বাংলা ভাষা।

স্বাধীনতার এত বছর পরে সন্দেহ হচ্ছে, সত্যিই কি আমার মাতৃভাষা আমার গর্ব, আমার আশা! হয়তো ছিল এককালে। এখন বাংলা বলা আর আশা-ভরসা নয়। বরং চরম অগৌরবের, চূড়ান্ত হেনস্তার। এখন, এই অমৃতকালে বাংলা বললে অন্য রাজ্যে ঘাড়ধাক্কা খেতে হয়। শুনতে হয়, তুমি বাংলাদেশি। তোমার বাপ-ঠাকুরদা চোদ্দো পুরুষের এই ভিটেতে তোমার ঠাঁই হবে না। তুমি বেরিয়ে যাও। এ দেশ তোমার নয়। মুসলিম হলে তো কথাই নেই। পত্রপাঠ ঘাড়ধাক্কা।

তারপরেও হেনস্তা। দুই দেশের সীমান্তে ঠেলাঠেলি। এ বলে এরা আমাদের নয়, ও ঠেলে পাঠায় এপারে। শুধু বাঙালি বলে, শুধু বাংলা ভাষায় কথা বলাবলি করেন বলে। এখন ব্যাপক হারে শুরু হয়েছে এই বিতাড়নপর্ব। হাজার প্রমাণ দেখালেও রেহাই নেই, হাতে-পায়ে ধরলেও না। সোজা ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে এই রাজ্যে, যেখান থেকে তাঁরা ভিনরাজ্যে কাজ করতে গিয়েছিলেন। কখনও বা রাজ্য সরকারকে থোড়াই কেয়ার, সরাসরি তুলে দেওয়া হচ্ছে বিএসএফের হাতে। তারাই পুশ ব্যাক করছে বাংলাদেশে।

যেমন কোচবিহারের আটজন। বাংলাদেশি সন্দেহে আটক করা হয়েছিল যাঁদের। পরে একজনকে ছেড়ে দিলেও বাকি সাতজন এখনও আটক। তাঁরা দিল্লিতে কাজ করছিলেন ইটভাটায়। তাঁদের সচিত্র বৈধ পরিচয়পত্র থাকলেও পুলিশ কোনও কথা শোনেনি। ওই সাতজন কোচবিহারের দিনহাটার সাবেক ছিটমহলের বাসিন্দা। ওই খবরে ক্ষোভ আর উদ্বেগ ছড়িয়েছে এলাকায়। ওই সাতজনের পরিবার তাঁদের উদ্ধারের জন্য পুলিশের দ্বারস্থ হয়েছে। দিনহাটা থানার সামনে নিজেদের পরিচয়পত্র নিয়ে দাঁড়িয়েও ছিলেন তাঁরা।

শুধু এই একটা ঘটনা নয়, অতি সম্প্রতি মহারাষ্ট্র পুলিশ বাংলার কয়েকজনকে পাকড়াও করে বাংলাদেশে পুশব্যাক করেছিল। পরে বিএসএফ-বিজিবির ফ্ল্যাগ মিটিংয়ের পর বাড়ি ফিরতে পারেন তাঁরা। একইরকম খবর আসছে গুজরাট, রাজস্থান,  উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা, ওডিশা থেকে। উত্তরপ্রদেশের দেওরিয়ায় বাংলাদেশি সন্দেহে ৬ জন বাঙালিকে আটক করা হয়েছিল। তাঁরা কেউ বেলডাঙ্গার, কেউ নদিয়ার কৃষ্ণগঞ্জের বাসিন্দা। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে রাজ্য প্রশাসনের চেষ্টায় রেহাই পেয়েছেন তাঁরা। বেশকিছু বাঙালিকে আটকে রাখা হয়েছিল রাজস্থানের ভিওয়ান্ডিতেও। যাঁরা উত্তর দিনাজপুরের ইটাহারের বাসিন্দা।

গত ২৯ মে ছত্তিশগড়ের রায়পুরে পুলিশ আটক করে হুগলির ২৬ জনকে। তাঁদের বিরুদ্ধে একটাই প্রমাণ ছিল পুলিশের হাতে, তাঁরা কথা বলছিল বাংলায়। তাঁদের মধ্যে ৫ জনকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছিল। পরে নাগরিকত্ব প্রমাণ করে ছাড়া পান তাঁরা। বছর পনেরো তাঁরা কাজ করছেন ছত্তিশগড়ে। তাঁদের প্রশ্ন একটাই, বাংলা বলা কি অপরাধ? নিজের দেশে কি আমরা মাতৃভাষায় কথা বলতে পারব না?

এই ঘটনার কিছুদিন আগে দুর্ভোগের পড়তে হয়েছিল কোচবিহারের দিনহাটা এলাকার ১২ জনকে। রাজস্থানের শিকার জেলার পান থানার পুলিশ তাঁদের সবাইকে বাংলাদেশি বলে টানা ন’দিন আটকে রেখেছিল। তাঁদের অপরাধ, তাঁরা কথা বলছিলেন বাংলায়। বহু আবেদন-নিবেদনের পর বৈধ কাগজপত্র দেখিয়ে রেহাই পান তাঁরা। তাঁরা বহুদিন ধরে সেখানে ইটভাটার শ্রমিক।

তবে ভাগ্য এত সুপ্রসন্ন ছিল না নদিয়ার ২৮ বছরের তরুণ শফিকুল শেখের। রাজস্থানেরই লালকোঠারি থানার পুলিশ তাঁকে তুলে নিয়ে আটকে রেখেছে ডিটেনশন ক্যাম্পে। উদ্বিগ্ন তাঁর পরিবার। অসমের গোলাঘাটের নুমালিগঞ্জে মুর্শিদাবাদের ১২ জন দিনমজুরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। পুলিশ তাঁদের সব পরিচয়পত্র, মোবাইল কেড়ে নিয়েছিল। তারপর এ রাজ্যের প্রশাসনের চেষ্টায় ছাড়া পান তাঁরা।

উত্তরপ্রদেশের মথুরায় গাছের নীচে বসে বাংলায় কথা বলছিলেন ইসলামপুর আর ভগবানগোলার পাঁচ শ্রমিক। তাঁদের কাছে আধার, ভোটার কার্ড থাকা সত্ত্বেও তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয় গোবিন্দপুর থানায়। এ রাজ্যের প্রশাসনিক কর্তাদের উদ্যোগে ছাড়া পান তাঁরা। উত্তরপ্রদেশেরই বালিয়ার রসরাজ এলাকায় প্লাস্টিকের জিনিসপত্র বিক্রেতা একাধিক বাঙালি মুসলিমকে বেদম মারধর করা হয়। তাঁরা মুর্শিদাবাদের বড়ঞার বাসিন্দা। তাঁদের ঘিরে ধরে আধার কার্ড চাওয়া হয়। তারপর সেসব ছিঁড়ে ফেলা হয়। জোর করে তাঁদের জয় শ্রীরাম বলানো হয় বলে জানাচ্ছেন তাঁরা।

পহলগামের ঘটনা আর মুর্শিদাবাদের গোলমালের পর হামলার মাত্রা আরও বেড়েছে। ভয়ে অনেকে পুলিশের কাছে যেতে চাইছেন না। পড়শি অসমে নতুন চেহারায় ‘বঙ্গাল খেদা’ ফিরে এসেছে এনআরসি’র হাত ধরে। ডি-ভোটার সন্দেহে ওপারে পাঠানোর চেষ্টা হয় এপারের ১৪ জনকে। তাঁরা দু’দেশের মাঝে নো ম্যানস ল্যান্ডে আটকে পড়েছিলেন। খোলা আকাশের নীচে টানা চারদিন ঝড়-জলের মধ্যে বসে ছিলেন তাঁরা। তাঁদের মধ্যে ছিলেন এক মহিলা আর এক সদ্যোজাত।

বিএসএফ আর ওপারের বিজিবির অনেক ঠেলাঠেলির পর ফিরিয়ে আনা হয় তাঁদের। দশ বছর আগে ছিটমহল চুক্তি হলেও দুর্দশা, দুর্ভোগ মেটেনি সেখানকার আদি বাসিন্দাদের। ভিনরাজ্যে তাঁদের বিপদ বরং আরও বাড়ছে। এসব কি গর্ব করার, আশা করার মতো কিছু? দেশের এক রাজ্যের মানুষ অন্য রাজ্যে কাজ করতে যেতে পারবেন না? এ রাজ্যেও তো কত মানুষ কাজ করতে আসেন। কত মানুষ এখানেই থেকে যান বংশপরম্পরায়। সবাই তো ভারতীয়, এক দেশের নাগরিক।

বৈধ পরিচয়পত্র থাকা সত্ত্বেও শুধু বাংলা বলার জন্য অত্যাচারের শিকার হতে হবে কেন বাঙালিদের? কত আবেগ নিয়ে কবি লিখেছিলেন, ‘ওই ভাষাতেই প্রথম বোলে, ডাকনু মায়ে ‘মা’ ‘মা’ বলে, ওই ভাষাতেই বলবো ‘হরি’, সাঙ্গ হলে কাঁদা-হাসা।’ যিনি এই পংক্তিগুলি লিখেছিলেন, সেই অতুলপ্রসাদ সেন জীবনের অনেকটা সময় কাটিয়েছেন লখনউতে। তিনিও ছিলেন প্রবাসী বাঙালি। তবে তখন তো অমৃতকাল শুরু হয়নি।



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *