আপা ও দিদি: মিল-অমিলের নকশিকাঁথা

আপা ও দিদি: মিল-অমিলের নকশিকাঁথা

শিক্ষা
Spread the love


রূপায়ণ ভট্টাচার্য

ইদানীং পরিচিতদের যেসব ফোন আসে বাংলাদেশ থেকে, সবেতেই বেদনামাখা সুর। সেই চিরকালীন বাংলা গানের সঙ্গে মিলে যায়—‘কী চেয়েছি আর কী যে পেলাম/ সাধের প্রদীপ জ্বালতে গিয়ে নিজেই আমি পুড়ে গেলাম।’

পরিচিত সাংবাদিকদের গলায় শেখ হাসিনার জন্য সহানুভূতিই বেশি এখন। এক বছরের মধ্যে তাঁদের উপলব্ধি, ন্যূনতম শৃঙ্খলা অন্তত হাসিনার আমলে ছিল দেশে। এখন যা আদৌ নেই। কোথায় কখন কী হবে, কার প্রাণ চলে যাবে, কার সর্বস্ব লুটপাট হয়ে যাবে, কাকে উগ্র জনতা এসে মেরে ফেলে যাবে, কেউ জানেন না। সংস্কৃতি? নেই। গান? নেই। সিনেমা? নেই।

তাহলে প্রাণের বাংলাদেশ, কী পড়ে রইল তোমার জন্য? বিশৃঙ্খলা, হানাহানি, রক্তপাত ও অবিশ্বাস। শ্রাবণে সবুজ হয়ে থাকে বাংলার প্রতিটি প্রান্তর, জলধারায় বাসা বাঁধে এগিয়ে চলার বাসনা। আকাশে সাদা ও কালো মেঘের লুকোচুরিতে মিনিটে মিনিটে বদলায় চিত্রকল্প। নদীরা সেই বদলের ধারাপাত ধরে রাখে বুকে। এমন অনন্য প্রাকৃতিক রূপ দেখার মনও আজ কারও নেই সেই স্বর্গীয় পটভূমিতে।

হাসিনা কী করে গিয়েছেন, যার জন্য তাঁকে এতটা খেসারত দিতে হল?

প্রশ্নটার ব্যাখ্যা খুঁজতে নেমে হাসিনা জমানার প্রবল দুর্নীতির কথা মনে পড়ে। এবং সেখানে দেখি কোথাও কোথাও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে অনেকটা মিল হাসিনার। হাসিনা হয়তো নিজে সরাসরি দুর্নীতি করেননি। তবে দুর্নীতিগ্রস্ত লোকগুলোকে প্রশ্রয় দিয়ে গিয়েছেন অবোধ্য কারণে। আকাশছোঁয়া দুর্নীতি দেখেও তাঁদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেননি। এবং ধীরে ধীরে সেই দুষ্টচক্র ঘিরে ফেলেছে হাসিনাকে। হাসিনা তখন অসহায়, শাজাহানের চেয়েও অসহায়।

মানবিক হাসিনাকে নিঃস্বার্থ ভালোবাসার লোক আজও লক্ষ লক্ষ। তাঁরা আপার জন্য রক্ত দিতেও রাজি, দিতে রাজি প্রাণ। অথচ পথের এই লোকগুলোকেই দূরে সরিয়ে রেখেছে হাসিনার বৃত্তে থাকা নেতারা। জনতাকে ঘেঁষতে দেয়নি। এই নেতারা আসলে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা। দাদা-ভাই-কাকা-মামার সূত্রে নেতা হয়ে বসেছে এবং প্রত্যেকে চালাচ্ছে ব্যক্তিগত সিন্ডিকেট।

এবং হাসিনাও আসল সব সত্য জানতে পারেননি। কীভাবে আওয়ামী লিগের পায়ের তলার জমি ধীরে ধীরে ধসে যাচ্ছে। কীভাবে তাঁকে ভুল বোঝানো হচ্ছে। কীভাবে বঞ্চনার শিকার হয়ে হাসিনাকে প্রকৃত ভালোবাসার মানুষগুলো দূরে সরে যাচ্ছে। দূরে, অনেক দূরে।

যে অসৎ, ধান্দাবাজ, তোলাবাজদের কথায় হাসিনা শেষদিকে চলতেন, প্রশাসন চালাতেন, তাঁরাও অধিকাংশই পালিয়েছেন আজ। তাঁদের তো মুজিব বা হাসিনা বা আওয়ামী লিগকে ভালোবাসার কোনও দায় ছিল না। ছিল দাদাগিরি চালিয়ে, লুটেপুটে নিজেদের ঘর গোছানোর দায়। এখন নেতৃত্বহীন উন্মত্ত দেশে যাঁরা রক্ত মেখে, স্বজনহারানোর যন্ত্রণা সহ্য করে পালটা প্রতিরোধে আওয়ামী লিগের পতাকা নিয়েছেন, তাঁদেরই হাসিনা শেষদিকে উপেক্ষা করে গিয়েছেন।

হাসিনাকে সেই সময় কেউ কিছু বলতে এলে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী যাদের ওপর সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব দিতেন, আসলে জনতার ক্ষোভ ছিল তাদের ওপরই। তাদের আত্মীয়দের ওপর। তাদের সিন্ডিকেটের ওপর। এরাই তো পুকুর চুরি করছে দিনের পর দিন। ওই নেতা-মন্ত্রীরা কি ন্যায়বিচার দেবে জনতাকে? তারা বরং জনতার আপাকে ভুল বুঝিয়ে দিয়ে বলত, সব ঠিক আছে আপা। ওরা আসলে বিএনপির লোক। তাই ওরা এসব বলছে।

ঢাকার বন্ধু সাংবাদিকদের কাছে এসব তথ্য শুনি। এবং কলকাতায় মমতার চারপাশের লোকগুলোর কথা মনে হয়। দিদির কাছে অভিযোগ নিয়ে পৌঁছালে যাঁদের কাজই হল মমতাকে একটা কথা বলে দেওয়া। দিদি আসলে ওরা বিজেপির লোক। তাই এত অভিযোগ করছে। নীতি এক, চৌকাঠ থেকেই বের করে দাও।
পদ্মাপারে বিএনপি ছিল, গঙ্গাপারে বিজেপি।

ফলে আসল অভিযোগের ঝুলি থেকে সত্যগুলো বেরোচ্ছেই না আর। আরজি কর হাসপাতালে, সন্দেশখালিতে, টালিগঞ্জে সিনেমাপাড়ায়, সল্টলেকের শিক্ষা দপ্তরে, নন্দনের সাহিত্য ও সংস্কৃতি কেন্দ্রে, ময়দানের ক্লাব ও রাজ্যের বিভিন্ন ক্রীড়া সংস্থায়। বাজার গরম করতে, আরজি কর, সন্দেশখালিতে ভুল ও বানানো অভিযোগ তুলে, নিজেদের পায়ে কুডুল মেরেছে বিরোধী দলগুলো। তবে মা‌ৎস্যন্যায় ও দাদাগিরি যে দুটো জায়গায় চলছিল, তা তো অস্বীকারের উপায় নেই। ওইসব খবর মমতার কাছে আগে পৌঁছায়নি কেন? ঘনিষ্ঠ চক্রই পৌঁছাতে দেয় না।

এই যে শিলিগুড়ি, কোচবিহার, মালদা, জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, দুই দিনাজপুরেতে ধিক্কৃত নেতারা যা খুশি করে যাচ্ছেন, ভালো লোকদের কাজ করতে দিচ্ছেন না, অসততা ধরার পরেও শাস্তি দিতে ব্যর্থ, বিধায়ককে তাড়া করছে মানুষ– এ সব খবর কি মমতার কাছে পৌঁছেছে? মনে হয় না। মমতার নিজের চক্রের লোকেরা এসব খবর পৌঁছাতে দেবেন না। নেহাত বিরোধীরা শতচ্ছিন্ন, তাই তৃণমূল এখনও দাঁড়িয়ে। মমতারও ব্যর্থতা, তিনি নিজে সরাসরি খবর নেওয়ার খিদে হারিয়েছেন। হাসিনার ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার দেখা গিয়েছিল।

বহু আগে একবার লিখেছিলাম, পুনরাবৃত্তি হয়ে যাবে বলেও আবার লিখছি–বাংলাদেশের চূড়ান্ত অস্থিরতার প্রভাব এই বাংলার নির্বাচনেও পড়বে। দুর্গাপুজোয় এবার কী থিম বাংলা কাঁপাবে, স্পষ্ট নয়। তবে আপাতদৃষ্টিতে বাংলার নির্বাচনের থিম এই মুহূর্তে বাঙালিয়ানা এবং হিন্দুত্ব। জোড়াফুল জোর দিচ্ছে বাঙালিয়ানায়, পদ্মফুল জোর দিচ্ছে হিন্দুত্বে। এখানে বাংলাদেশকে অস্বীকার করবেন কী করে?

ইতিমধ্যেই এই বাংলার দুটো প্রধান দল যে ইস্যুতে জোর দিচ্ছে তার মধ্যে রয়েছে সীমান্তে তুমুল বিশৃঙ্খলা, বেআইনি অনুপ্রবেশকারী, বাংলাদেশি ভেবে বাঙালিকে হেনস্তা করা, বাংলাদেশিদের এখানে এসে ভোটার হয়ে ওঠা, এক একটা মহল্লায় বাংলাদেশিদের চলে আসা, বিএসএফের নিষ্ক্রিয়তা, সীমান্ত এলাকায় নেতাদের টাকা নিয়ে আধার কার্ড করা, এপার বাংলার লোকদেরই সীমান্তে বিএসএফের পুশব্যাক করে দেওয়া।

সবকিছুর মধ্যেই দেখুন, বাংলাদেশ কোনও না কোনওভাবে জড়িয়ে। উন্নয়ন, দুর্নীতি, সিন্ডিকেট, কেন্দ্রের বঞ্চনা, গণতন্ত্রের সংহার– সব বহুদিন অনেক পিছনে চলে গিয়েছে রাতারাতি।

দুই বাংলার সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে মিল অনেক। সাম্প্রদায়িকতাকে দুই নেত্রীই বহু চেষ্টায় বশে আনতে পারেননি। পদ্মাপারে ক্রমবর্ধমান উগ্র মুসলিমবাদের জামায়েতে। গঙ্গাপারে উগ্র হিন্দুত্ববাদের বিজেপি। ওপারেও কমিউনিস্টরা দিশেহারা। কাকে বাছবে? হাসিনাকে তাড়ানোর জন্য উগ্র মুসলিমদের সমর্থন করতে গিয়ে, দেশের কি আরও ক্ষতি হয়ে গেল না? উত্তর খুঁজে মরছে।

এপারেরও বামপন্থীরা একইভাবে উত্তর খুঁজে বেড়াচ্ছে রাজ্যে। দলে একমত নয় কেউ। জাতীয় স্তরে কেরল বাদে বামপন্থীদের ততটা সংশয় নেই। বিজেপিকে দূরে রাখতে তারা কেরল বাদে সর্বত্র কংগ্রেসের হাত ধরতে তৈরি। এই বাংলায় দ্বিধায় খানখান।

বাঙালিদের ভিনরাজ্যে হেনস্তা নিয়ে রাজ্য সম্পাদক সেলিম এক কথা বলছেন। আবার তাঁদের প্রধান মুখপত্রের সম্পাদকীয়তে অন্য কথা বলা হচ্ছে। রাজ্যে সিপিএমের বিশৃঙ্খলা মনে করিয়ে দিচ্ছে বিজেপির চরম গোষ্ঠীদ্বন্দ্বকে। দুটো পার্টিতেই টিভিতে বলার জন্য কিছু লোক বসে আছেন। তাঁরাই বলবেন। আর কাউকে বলতে দেবেন না। এঁরা আবার কাউন্সিলারের ভোটে দাঁড়ালেও জিততে পারবেন না। সংগঠন শূন্য। তৃণমূল এখানেই অনেকটা এগিয়ে। হাসিনার যোগ্য বিকল্প যেমন বাংলাদেশ এক বছরেও খুঁজে পায়নি, এখানে মমতার বিকল্পও পায়নি বিরোধীরা। প্রধান বিরোধী নেতা শুভেন্দু অধিকারীর কথার উগ্রতা ওপারের জামায়াতে নেতার উগ্রতার ভাষা মনে করায়।

অবশ্য আপনি বলতে পারেন, সে তো বাংলাদেশেও এক বছর আগে আওয়ামী লিগের সংগঠন অনেক বেশি ভালো ছিল বিএনপি বা জামায়াতের তুলনায়। সে তো তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ল পুলিশ-প্রশাসন হাতে থাকার পরেও।

পদ্মা-মেঘনার দেশে আজ সংবাদমাধ্যমে আসল খবর পাওয়া একেবারেই অসম্ভব। সব সংবাদমাধ্যমেই ইউনূস সরকারের পছন্দের খবর ছাপতে হচ্ছে, বলতে হচ্ছে। গোপালগঞ্জে যে ভয়াবহ ঘটনা ঘটল, তার প্রতিফলন পাবেন না কাগজে-টিভিতে। বরং সব জায়গায় খবর শুনে মনে হবে, আওয়ামী সমর্থকরাই জঙ্গিবাহিনী। সরকার বলে দিয়েছে, আওয়ামী লিগ সংক্রান্ত কোনও খবর ছাপানো যাবে না। জাতীয় পতাকা বিক্রি করা তরুণকেও সেখানে ইউনূসের পুলিশ পেটায়। আওয়ামী সমর্থককে গুলি করে মারে অকারণ। ইউটিউব, ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপের খবর শুনেও আসল সত্য পাওয়া কঠিন। কেউ এ পক্ষের খবর দেবে, কেউ ও পক্ষের।

গঙ্গা-তিস্তার রাজ্যেও অধিকাংশ সংবাদমাধ্যম একেবারে আড়াআড়ি বিভক্ত। কেউ তৃণমূলের কথাই তুলে ধরে, কেউ বিজেপির। টিভি দেখলে, শুনলে বোঝা যায়, কে কোন দলের সমর্থক। বিভিন্ন জেলায় সব পার্টির বড় মেজো সেজো ছোট নেতারা নিজস্ব ইউটিউব ও ফেসবুক লাইভ বাহিনী নামিয়ে ফেলেছেন নিজস্ব প্রচারের জন্য।

দুই বাংলাতেই বৃষ্টির সময় এখন। সবুজের সময়। দু’চোখ জুড়িয়ে যাওয়া সবুজ। যতদূর চোখ যায় সবুজ শস্যক্ষেত্র। শুধু দু’পারের উগ্র, রক্তঝরানো রাজনীতিই মানুষের মনকে সবুজ থাকতে দিচ্ছে না আর।



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *