শুভজিৎ দত্ত, নাগরাকাটা: বৃষ্টি নেই, উদ্বেগ আছে।
গত বছরের থেকে এবারের জুন মাসে উত্তরবঙ্গে বৃষ্টির পরিমাণ অর্ধেকেরও কম। চলতি জুলাই মাসের পরিস্থিতিও এখনও পর্যন্ত তথৈবচ। কাগজে-কলমে ঘোর বর্ষা চললেও কবে থেকে মৌসুমি বায়ুর বৃষ্টি পাওয়া যাবে তা এখনও নিশ্চিত নয়। এমন পরিস্থিতিতে ডুয়ার্স, তরাই ও পাহাড়ের চা শিল্পের কার্যত নাভিশ্বাস দশা হয়েছে। চা গবেষণা সংস্থার (টিআরএ) উত্তরবঙ্গ আঞ্চলিক গবেষণা ও উন্নয়নকেন্দ্রের সর্বশেষ প্রকাশিত বুলেটিন অনুযায়ী ডুয়ার্সের ৬৭টি চা বাগান মিলিয়ে এবারের জুনে গতবারের থেকে উৎপাদন ১০ শতাংশ মার খেয়েছে (Tea Manufacturing)। তরাইয়ের ৩২টি বাগান মিলিয়ে এই ক্ষতির পরিমাণ সাড়ে ছয় শতাংশ। পাহাড়ের পরিস্থিতিও খুব একটা ভালো নয়।
সংস্থার চিফ অ্যাডভাইজারি অফিসার ডঃ শ্যাম ভার্গিস বললেন, ‘আবহওয়ার প্রতিকূলতার কারণে পূর্ব ডুয়ার্সের চা বাগানগুলি সবথেকে প্রভাবিত হয়েছে। মাদারিহাট-বীরপাড়া, কালচিনি, কুমারগ্রামের বাগানগুলিতে জুন মাসে ১০ থেকে ২৫ শতাংশের মতো উৎপাদন কম হওয়ার তথ্য মিলেছে। তাপমাত্রা বেশি থাকায় লুপার, হেলোপেলটিস, রেড স্পাইডার, গ্রিন ফ্লাই, থ্রিপস–এর মতো পোকামাকড়ের পাশাপাশি ব্যাকটিরিয়াল ব্লাইট, ফিউসেরিয়াম ডাইব্যাক, গ্রে ব্লাইট, ব্রাউন ব্লাইট, রেড রাস্ট–এর মতো ব্যাকটিরিয়া, ছত্রাক ঘটিত নানা ধরনের রোগ পাল্লা দিয়ে বেড়েছে।’ টিআরএ-র তরাই শাখার অ্যাডভাইজারি অফিসার ডঃ তৃণা মণ্ডলের বক্তব্য, ‘এখানকার সমস্ত বাগান ধরলে জুন মাসের উৎপাদন শতকরা ২৫ শতাংশ কম ছিল। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত একটানা উচ্চ তাপমাত্রা থাকায় গাছে নতুন কুঁড়ি আসার কাজটি বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে।’ সংস্থার দার্জিলিংয়ের অ্যাডভাইজারি অফিসার ডঃ বাদল লস্কর বললেন, ‘শুধু বৃষ্টিপাত বা তাপমাত্রা নয়। উৎপাদন কম হওয়ার পেছনে আরও নানা ফ্যাক্টর কাজ করে। আমাদের কাছে যা রিপোর্ট রয়েছে তাতে পাহাড়ের পরিস্থিতি একেবারে হতাশাজনক সেটা এখনই বলা যাচ্ছে না।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আবহাওয়া অফিস খুব একটা স্বস্তির খবর শোনাতে পারছে না। কেন্দ্রীয় আবহাওয়া দপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত বছর উত্তরবঙ্গ ও সিকিম মিলিয়ে জুন মাস পর্যন্ত ৭২১.১ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছিল। এবার তা কমে মোটে ৩২১.৩ মিলিমিটারে দাঁড়িয়েছে। গত বছরের জুলাই-এ প্রথম ১০ দিন উত্তরবঙ্গজুড়েই ভারী বৃষ্টিপাত হয়েছিল। এবার নেই বললেই চলে। ফলে বর্ষার বৃষ্টি শুরু হলেও যে ঘাটতি হয়ে গিয়েছে তা যে আর পূরণ হবে না সেব্যাপারে আবহবিদদের কোনও সংশয় নেই। আবহাওয়া দপ্তরের সিকিমের কেন্দ্রীয় অধিকর্তা ডঃ গোপীনাথ রাহা বলেন, ‘মৌসুমি অক্ষরেখার পূর্ব প্রান্ত এখন দক্ষিণে রয়েছে। এটা উত্তরে সরে এলে তবেই এখানে বর্ষার বৃষ্টি বলতে যা বোঝায় সেটা পাওয়া যাবে। এজন্য অপেক্ষা করতে হবে। এখন যে বৃষ্টি হচ্ছে সেটা জায়গাভিত্তিক বজ্রগর্ভ মেঘ তৈরি হয়ে।’
উত্তরের সার্বিক বৃষ্টিপাত যে জুন মাসে অর্ধেক কিংবা জুলাইতে তারও কম সেই প্রতিচ্ছবি চা বাগানগুলির নিজস্ব বৃষ্টিমাপক ব্যবস্থাতেও ধরা পড়ছে। যেমন ডুয়ার্সের মেটেলি ব্লকের ইনডং চা বাগানের তথ্য বলছে সেখানে গতবছরের জুন মাসে মোট ১১৪১ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছিল। এবারের জুনে ছিল ৬১৮ মিলিমিটার। গতবারের জুলাইয়ের ১১ তারিখ পর্যন্ত ৬০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছিল। এবার ২৭৯ মিলিমিটার হয়েছে। পরিস্থিতি এমনই পূর্ব ডুয়ার্সের একাধিক বাগানকে নজিরবিহীনভাবে কৃত্রিম সেচের আশ্রয়ও নিতে হচ্ছে বলে চা মহল জানাচ্ছে। ইনডং–এর সুপারিন্টেন্ডেন্ট ম্যানেজার রজত দেব বলেন, ‘দ্রুত যদি বৃষ্টি না নামে তবে পরিস্থিতি যে আরও সঙ্গিন হয়ে উঠবে তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই।’
চা বণিকসভাগুলির কর্তাদের কণ্ঠেও উদ্বেগের সুর। ডিবিআইটিএ-র সচিব শুভাশিস মুখোপাধ্যায় বলছেন, ‘বহু বাগানের কার্যত ভেন্টিলেশনে চলে যাওয়ার জোগাড় হয়েছে। উৎপাদন মার খাওয়ার পাশাপাশি জলবায়ুর এরকম পরিবর্তনের কারণে চায়ের গুণগতমান ও সেইসঙ্গে দামের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।’ আইটিপিএ-র ডুয়ার্স শাখার সম্পাদক রামঅবতার শর্মার কথায়, ‘সংগঠিত ক্ষেত্রের বাগানগুলিতে উৎপাদন কম তো রয়েইছে। আশ্চর্যজনকভাবে শিলিগুড়ি চা নিলামকেন্দ্রে গড়ে গতবারের থেকে দাম কিলো প্রতি গড়ে ৫০ টাকা কমে গিয়েছে। উচ্চপর্যায়ের সরকারি হস্তক্ষেপ অত্যন্ত জরুরি।’ টিপা-র চেয়ারম্যান মহেন্দ্র বনসল বলেন, ‘ডুয়ার্স-তরাই-এর পরিস্থিতি নিয়ে আমরা চিন্তিত।’ জলপাইগুড়ি জেলা ক্ষুদ্র চা চাষি সমিতির সম্পাদক বিজয়গোপাল চক্রবর্তী বলেন, প্রতিকূল পরিস্থিতিতে গোদের ওপর বিষফোড়ার মতো কাঁচা পাতার ন্যায্য দাম মিলছে না। কিলোপ্রতি ১৪-১৫ টাকায় পাতা বিকোচ্ছে। যেখানে উৎপাদন খরচ অন্তত ১৮ টাকা।’