শুভজিৎ দত্ত, নাগরাকাটা: তখন কেউ দ্বাদশ শ্রেণিতে পাঠরত। কেউ আবার পা দিয়েছে কলেজের চৌকাঠে। নিজেদের আজন্মের ভিটে চা বাগানে (Tea Backyard) মজুরি-বেতন শুধু অনিয়মিতই নয়। তালা ঝুলিয়ে মালিকপক্ষের পগারপার হওয়ার দৃশ্যও যেন গা সওয়া। এদিকে, বকেয়া পাওনাগন্ডার দাবিতে মায়েদের করুণ আর্তি। সাড়া না মিললে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাওয়া আন্দোলন।
এমন পরিস্থিতি শিক্ষিত প্রজন্মের চা বাগানের কয়েকজন মেয়ে বেঁচে থাকার অন্য লড়াইয়ের স্বপ্ন দেখেছিলেন। শুধু নিজেরা কিছু করবেন নয়, সেই লড়াই দিশা দেখাবে চা বাগানের আর পাঁচটা মেয়েকেও। একাজে তাঁরা হাতিয়ার করেন সমবায়কে। দুটি পাতা-একটি কুঁড়ির রাজ্যে কাঁচা পাতা তোলার কাজ না করেও যে স্বনির্ভর হওয়া যেতে পারে, সেই কল্পনাই এখন ডানা মেলছে তাঁদের হাত ধরে।
পাঁচ বাগান কন্যা এবার শিল্প গড়ার প্রশিক্ষণ নিতে ডাক পেয়েছেন দিল্লি (Delhi) থেকে। ন্যাশনাল কোঅপারেটিভ ইউনিয়ন অফ ইন্ডিয়ার (NCUI) তরফে তাঁদের ১০ দিনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে উদ্যোগপতি হওয়ার জন্য। যার পোশাকি নাম আন্ত্রাপ্রেনরশিপ ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম ফর উইমেন কোঅপারেটিভ। কালচিনি চা বাগানের আস্থা ওরাওঁ, ডিমডিমা চা বাগানের সঞ্জনা লামা, মধু চা বাগানের কণিকা ধানোয়ার এবং হান্টাপাড়ার বুনু জোজো ও অনীতা মুন্ডা শনিবার নর্থ-ইস্ট এক্সপ্রেসে দিিল্ল রওনা দিলেন চা বাগানের মেয়েদের শুধু স্বনির্ভরতা নয়, আরও পাঁচজনকে কর্মসংস্থানের স্বপ্ন দেখাতে।
তাঁদের স্টার্ট আপ-এর কাহিনীর শুরু বছর তিনেক আগে। অনিয়মিত হয়ে পড়া মজুরি-বেতন ও সেইসঙ্গে যখন তখন বাগান বন্ধ হয়ে যাওয়ার দুঃসহ যন্ত্রণার সাক্ষী কণিকা, সঞ্জনা বা আস্থার মতো তরুণীরা প্রথমে নিজেদের এক চিলতে বাড়িতেই কেউ মাশরুম চাষ, আবার কেউ সেলাই শুরু করেন। তাঁদের দেখে এগিয়ে আসেন শ্রমিক মহল্লার অন্য মেয়েরাও। ধীরে ধীরে সবাইকে একজোট করে নিজেদের এলাকায় তাঁরা গড়ে তোলেন সমবায়। একাজে সহযোগিতা মেলে শুভান্যুধ্যায়ীদের কাছ থেকে। রেজিস্ট্রেশনের কাজও সেরে ফেলেন সরকারি নিয়ম মেনে। এখন চলছে জোটবদ্ধভাবে এগিয়ে যাওয়ার পালা।
মধু বাগান বহুমুখী সমবায় সংস্থার সম্পাদক কণিকা ধানোয়ার বলেন, ‘যতটুকু করতে পেরেছি সেটা এখনও যথেষ্ট নয়। মূলত তহবিলের অভাবটাই বড় কিছু গড়ার মূল প্রতিবন্ধকতা।’ ডিমডিমা চা বাগানের বাসিন্দা ও বান্দাপানি বহুমুখী সমবায় সংস্থার নির্দেশক সঞ্জনা লামা এখন দূরশিক্ষার মাধ্যমে কলেজের পড়াশোনা করছেন। ওই তরুণীর কথায়, ‘এখানে ফিরে আসার পর দিিল্লর প্রশিক্ষণের অভিজ্ঞতা নিজেদের বাগানে প্রয়োগ করার চেষ্টায় কোনও খামতি রাখব না।’
কালচিনি, বান্দাপানি, মধু, হান্টাপাড়া ও মুজনাই চা বাগান মিলিয়ে সেখানকার মহিলাদের নিয়ে পাঁচটি সমবায় সংস্থা কাজ করছে। কোথাও আদিবাসী সম্প্রদায়দের ট্র্যাডিশনাল পোশাক বা রেডিমেড জামাকাপড় বিক্রি, কোথাও মাশরুম চাষ, আবার কোথাও বাহারি মোমবাতি বা সিমেন্টের ইট তৈরির প্রকল্প চলছে। একাজে যুক্ত হয়েছেন বাগানগুলির অন্তত শ-পাঁচেক মহিলা। অন্যদের উদ্বুদ্ধ করে চা বাগানে সমবায়ের আন্দোলনকে আরও ছড়িয়ে দেওয়ার কাজও তাঁরা চালিয়ে যাচ্ছেন নিজেদের মতো করে।
সহযোগিতা মিলছে সমবায় দপ্তরের পক্ষ থেকে। তবে বাগানে ছোটখাটো কোনও প্রকল্প করতে গেলেও জমির সমস্যা এখন তাঁদের সবচেয়ে বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিষয়টি নিয়ে প্রশাসনেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন তাঁরা। পশ্চিমবঙ্গ কোঅপারেটিভ ইউনিয়ন-এর ভাইস চেয়ারম্যান ও তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্য কমিটির সম্পাদক আশিস চক্রবর্তী বলেন, ‘ওই তরুণীদের কথা সবিস্তারে জানা আছে। দৃষ্টান্তমূলক কাজ করছেন ওঁরা। জমির বিষয়টি নিয়ে সমবায়মন্ত্রী প্রদীপ মজুমদারে সঙ্গে কথা হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীরও দৃষ্টি আকর্ষণ করা হচ্ছে। আমরা আশাবাদী।’
বেশ কিছুদিন আগে মধু চা বাগানের সমবায়টির কাজকর্ম দেখে যান রাজ্যের কৃষি বিপণনমন্ত্রী বেচারাম মান্না। হান্টাপাড়া চা বাগানের সমবায়টি সুফল বাংলা প্রকল্পে কৃষিজাত পণ্য বিক্রির জন্য একটি আউটলেট তৈরির পরিকল্পনা নিয়েছে।