সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: আর কালো নয়। হলুদ ডোরাকাটার যে সৌন্দর্য সুন্দরবনের দক্ষিণরায়কে রয়্যাল করে তুলেছে, সেই রংই এবার ফিরে পাবে ওড়িশার সিমলিপাল। জিনাত যে অন্তঃসত্ত্বা! আর জিনাত সঙ্গী ‘কিলা’ (কুইলা) নামে এখন পালামৌয়। তার জন্যও আসছে বাঘিনী।
সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগস্টের শেষ কিংবা সেপ্টেম্বরেই নতুন জিনগত বৈশিষ্ট্যের শাবক জন্ম দেবে বাঘিনী জিনাত। বলছে সিমলিপাল ব্যাঘ্র প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। আর জিনাতের টানে বাংলা-ঝাড়খন্ড প্রায় হাজার কিমি চষে বেড়ানো জিনাত সঙ্গীর অরিজিন ছত্তিশগড়। তার বাবা-মা গুরু-ঘাসিদাস ন্যাশনাল পার্কের। ডোরাকোটা প্যাটার্ন, ট্র্যাপ ক্যামেরার ছবি রেকর্ড করা নথির সাথে মিলিয়ে এই সিদ্ধান্তেই উপনীত হয়েছে পালামৌ ব্যাঘ্র প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। তবে ২০২৩ সালের অক্টোবরে ওই ব্যাঘ্র প্রকল্প সন্নিহিত পালামৌ দুর্গের কাছে ওই রয়্যাল বেঙ্গল দর্শন হওয়ায় তার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘কিলা’ (কুইলা)। সেই নামেই সফট রিলিজে এখন দিব্যি আছে সে। ট্র্যাপ ক্যামেরায় কিলিং-র ছবি ধরা পড়ায় সে যে শিকার করছে তাতে আর কোন সন্দেহ নেই। আগামী আগস্টেই ‘কিলা’ নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে ন্যাশনাল টাইগার কনজারভেশন অথরিটি অনুমোদিত কম্পোজিট কমিটি। রেডিও কলারের নজরদারিতে ‘বন্দি’ হবে? নাকি স্বাধীন জীবনে ঘুরে বেড়াবে ওই ভবঘুরে বাঘ। তবে
পালামৌ যাতে স্থিতিশীল ও প্রজননশীল বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে পারে সেই ব্যাপারেও পদক্ষেপ নিচ্ছে কর্তৃপক্ষ। নিয়ে আসা হবে একাধিক বাঘিনীকে। শুরু হয়েছে তার তোড়জোড়।
জিনাত ও জিনাত সঙ্গী। এই বাঘিনী ও বাঘকে নিয়ে কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি বাংলা, ঝাড়খন্ড থেকে ওড়িশাকে। ২০২৪ সালের ১৫ই নভেম্বর মহারাষ্ট্রের তাডোবা-আন্ধারি ব্যাঘ্র প্রকল্প থেকে সিমলিপালে নিয়ে আসা হয় সাড়ে তিন বছরের জিনাতকে। যাতে সেখানকার মেলানিস্টিক পুরুষ বাঘের সঙ্গে মেলামেশা হয়। হলুদ ডোরাকাটা রঙ যাতে ফিরে আসে এই ব্যাঘ্র প্রকল্পে।
তাই প্রথমে কোয়ারেন্টাইন। তারপর সফট রিলিজ। এরপরই ২৪ নভেম্বর রেডিও কলার পরিয়ে সিমলিপাল ব্যাঘ্র প্রকল্পে মুক্ত। চারদিন পর ২৮ নভেম্বর-ই ঘর ছাড়া সে। ১০ ডিসেম্বর ওড়িশা পেরিয়ে জামশেদপুর বন বিভাগের চাকুলিয়ায়। ২০ ডিসেম্বর ঝাড়গ্রামের বেলপাহাড়ির কাটুচুয়া জঙ্গলে। রেডিও কলার থাকায় ট্রাকিংয়ে জানা যায় ২১ ডিসেম্বর পুরুলিয়ার বান্দোয়ান এক বনাঞ্চলের রাইকা পাহাড়ে। চলতে থাকে বাঘবন্দি খেলা। ২৯ ডিসেম্বর দক্ষিণ বাঁকুড়া থেকে বন্দি হয় জিনাত। ৩১ শে ডিসেম্বর আলিপুর হয়ে আবারসিমলিপালে পা রাখে। আর ওই দিনই কার্যত তার পিছু পিছু জিনাত সঙ্গীর অবস্থান ধরা পড়ে ঝাড়খণ্ডের চান্ডিলে। তারপর বাংলা, ঝাড়খন্ড দুই রাজ্যকে
নাকানিচোবানি খাইয়ে দলমা থেকে বান্দোয়ান। আবার বেলপাহাড়ি থেকে বাঁকুড়া ছুঁয়ে একই পথে দলমা। সেখানে ঝাড়খণ্ড তার নাম দেয় ‘সম্রাট।’ এদিকে বাঘিনী জিনাতের নামও হয়ে গিয়েছে ‘গঙ্গা’। প্রধান মুখ্য বনপাল (বন্যপ্রাণ) প্রেমকুমার ঝাঁ জানান, “মেলানিস্টিক পুরুষ বাঘের সঙ্গে জিনাতের মেলামেশা সফল হয়েছে। আমরা আশাবাদী, নতুন জিনগত বৈশিষ্ট্যের শাবক জন্ম দেবে বাঘিনী জিনাত। আগস্টের শেষ কিংবা সেপ্টেম্বরের প্রথমেই ভালো খবরটা পাওয়া যাবে।”
গত ২৫শে জুন পুরুলিয়ার সীমানা ঝাড়খণ্ডের রাঁচি জেলার সিল্লি থানার মারদু গ্রামে গৃহস্থে ঢুকে পড়ার পর বন্দি হয় ‘কিলা’। পালামৌ ব্যাঘ্র প্রকল্প কর্তৃপক্ষের ডেপুটি ফিল্ড ডিরেক্টর প্রজেশকান্ত জেনা বলেন, “ডোরাকোটা প্যাটার্ন, ট্র্যাপ ক্যামেরার ছবি রেকর্ড থাকা নথির সাথে মিলিয়ে দেখা যায় এই রয়্যাল বেঙ্গলের অরিজিন ছত্তিশগড়। ২০২৩ সালের অক্টোবরে পালামৌ দুর্গের কাছে ওই বাঘের অবস্থান পাওয়া যায়। আর তারপরই তার নাম দেওয়া হয় ‘কিলা’। দুর্গকে হিন্দিতে ‘কিলা’ বলা হয়।” ওই ব্যাঘ্র প্রকল্প কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সফট রিলিজে একেবারে সুস্থ আছে সে। শিকার যে করছে তার প্রমাণ মিলছে ট্র্যাপ ক্যামেরায়। মিলছে কিলিং-র ছবি। কিছুদিনের মধ্যেই ওই রয়্যাল বেঙ্গল নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত-র দিকে তাকিয়ে পালামৌ ব্যাঘ্র প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। ডেপুটি ফিল্ড ডিরেক্টরের কথায়, “রেডিও কলার পরানো হবে নাকি ওই যন্ত্র ছাড়াই মুক্ত করা হবে, তা ঠিক করবে কাম্পোজিট কমিটি। তবে আগামী দিনে আমরা এখানে একাধিক বাঘিনীকে নিয়ে আসব। যাতে গোপন মেলামেশায় বংশবিস্তার করতে পারে।” সাম্প্রতিককালে এই ব্যাঘ্র প্রকল্পের ৬টি বাঘের ছবি ধরা পড়লেও সবকটি পুরুষ। বাঘিনী না থাকার কারণে কোন বাঘই এখানে স্থায়ীভাবে থাকতে চাইছে না। সেই কারণেই এই ব্যাঘ্র প্রকল্পের পরিধি বাড়াচ্ছে কর্তৃপক্ষ। তাই ওই প্রকল্প সন্নিহিত জাইগির, কুজরুম গ্রামকে অন্যত্র স্থানান্তর করেছে। এমনই মোট ৩৫ টি গ্রাম রয়েছে। যাদের স্থানান্তর করে পালামৌ ব্যাঘ্র প্রকল্পের আয়তন বাড়াবে কর্তৃপক্ষ। আপাতত প্রথম ধাপে রয়েছে আরও আটটি। ওই দুটি গ্রামের স্থানান্তরে প্রায় হাজার বর্গকিলোমিটার বাঘের বিচরণে সহায়ক হয়েছে পালামৌয়।

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন