শুভঙ্কর চক্রবর্তী, শিলিগুড়ি: স্বাধীনতার পর থেকেই উত্তরবঙ্গজুড়ে মাথাচাড়া দিয়েছে রাজ্য ভাগের আন্দোলন। কখনও পৃথক কোচবিহার বা কামতাপুর, কখনও গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে রক্তাক্ত হয়েছে উত্তরের মাটি। গোটা দেশ কাঁপিয়ে দেওয়া নকশাল আন্দোলনের আঁতুড় উত্তরবঙ্গই। ভারী শিল্পহীন উত্তরবঙ্গে কর্মসংস্থানের অভাবে বেড়েই চলছে পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা। দারিদ্র্যের সুযোগ কাজে লাগিয়ে বিচ্ছিন্নতাবাদী বা দেশবিরোধী শক্তিগুলি সক্রিয় হয়েছে বিভিন্ন জেলায়। জন্ম হয়েছে কেএলও’র। ছ’শো কিলোমিটার দূরে কলকাতায় বসে উত্তরের এইসব সমস্যা ঠিকভাবে বুঝে সমাধান করা যে সহজ কাজ নয় তা স্বীকার করে নিয়েছেন পোড়খাওয়া আমলারাও। তাই শক্তপোক্ত হচ্ছে শিলিগুড়িকে (Siliguri) দ্বিতীয় রাজধানী করার দাবি।
শিলিগুড়িকে রাজ্যের দ্বিতীয় রাজধানী (Second capital) হিসাবে চাইছেন পাহাড়ের নেতারাও। ভারতীয় গোর্খা প্রজাতান্ত্রিক মোর্চার সভাপতি এবং জিটিএ’র মুখ্যসচিব অনীত থাপার কথা, ‘শিলিগুড়ি দ্বিতীয় রাজধানী হলে খুবই ভালো হয়। নানা সমস্যা নিয়ে বারবার কলকাতা ছুটতে হবে না।’ গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার সভাপতি বিমল গুরুং অবশ্য মনে করছেন, অনেক আগেই শিলিগুড়িকে দ্বিতীয় রাজধানী করা উচিত ছিল। তাঁর ব্যাখ্যা, ‘উত্তরবঙ্গের জেলাগুলি বৈচিত্র্যে ভরা। এই এলাকায় নানা জনজাতির বসবাস। তাদের হরেক সমস্যা। পাহাড়ের সমস্যা একরকম, সমতলের অন্যরকম। চা বাগানের সমস্যার সঙ্গে অন্য কৃষিকাজের সমস্যা মেলে না। বাস্তবে সবটা না বুঝেই বারেবারে কলকাতা থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ফলে সমস্যা আরও জটিল হয়েছে। তাই শিলিগুড়ি দ্বিতীয় রাজধানী হওয়া উচিত।’
জাতীয় স্বার্থে চিকেন নেকের নিরাপত্তা নিয়ে বরাবর উদ্বিগ্ন কেন্দ্র। বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান- তিন দেশের সংযোগস্থলে অবস্থিত শিলিগুড়ি ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেই নিরাপত্তার প্রশ্নে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। উত্তরের আট জেলাই আন্তর্জাতিক সীমান্তে অবস্থিত। দেশবিরোধী শক্তিগুলি তাই নিরাপদ ঘাঁটি হিসাবে উত্তরবঙ্গকে বেছে নিয়েছে। জামায়াতে, এবিটি, আল-কায়দায় মতো জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো জেলায় জেলায় তাদের স্লিপার সেলের সদস্যদের ছড়িয়ে দিয়েছে। শিলিগুড়ি দ্বিতীয় রাজধানী হলে চিকেন নেকের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা মজবুত হবে বলেই মনে করছেন গোয়েন্দা এবং প্রাক্তন সেনাকর্তারা।
প্রাক্তন বায়ুসেনা আধিকারিক তরুণকান্তি রায়ের কথায়, ‘শুধু রাজনৈতিক চমক না দিয়ে শিলিগুড়িকে প্রকৃত অর্থেই দ্বিতীয় রাজধানী হিসাবে গড়ে তোলা উচিত। সেটা জাতীয় নিরাপত্তা সহ উত্তরবঙ্গের জন্য মাইলস্টোন হবে।’ কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার এক আধিকারিক জানিয়েছেন, বছর তিনেক আগেই কারণ উল্লেখ করে শিলিগুড়ির প্রশাসনিক গুরুত্ব বৃদ্ধির জন্য তাঁদের পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক ও রাজ্য সরকারের কাছে বিস্তারিত রিপোর্ট পাঠানো হয়েছে। শিলিগুড়ি দ্বিতীয় রাজধানী হলে তাদের কাজে সুবিধা হবে বলেই মনে করছেন ওই আধিকারিক।
বড় রাজনৈতিক দলগুলির প্রত্যেকেই কেউ ঘুরিয়ে কেউ সরাসরি শিলিগুড়িকে দ্বিতীয় রাজধানী করার পক্ষে সওয়াল করেছেন। প্রশাসনিক গুরুত্বের বিবেচনায় শিলিগুড়িকে দ্বিতীয় রাজধানী করা উচিত বলেই মনে করছেন তৃণমূল নেতা এবং ইংরেজবাজার পুরসভার চেয়ারম্যান কৃষ্ণেন্দুনারায়ণ চৌধুরী। কোনও রাখঢাক না রেখেই তিনি বলেন, ‘মুখ্যমন্ত্রী মিনি সচিবালয় তৈরি করেছেন। উত্তরবঙ্গ এখন অনেক বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। তবে নানা কাজে এখনও আমাদের কলকাতায় ছুটতে হচ্ছে। শিলিগুড়িকে দ্বিতীয় রাজধানী করার যে দাবি উঠেছে তা অন্যায্য নয়। শিলিগুড়িতে রাজধানী হলে সার্বিকভাবে উত্তরবঙ্গের গুরুত্ব আরও বাড়বে।’
কৃষ্ণেন্দুর মতো সোজাসাপটা কথা না বললেও শিলিগুড়িকে দ্বিতীয় রাজধানী করার দাবি এবং প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করেননি শিলিগুড়ির মেয়র গৌতম দেব। তাঁর কথা, ‘শিলিগুড়ি উত্তরবঙ্গের অলিখিত রাজধানী। মিনি সচিবালয়ও শিলিগুড়িতেই আছে। দ্বিতীয় রাজধানীর বিষয়ে সিদ্ধান্ত সরকারই নেবে।’ তাঁরাও যে শিলিগুড়িকে দ্বিতীয় রাজধানী করার পক্ষে, ঘুরিয়ে সেকথা মেনে নিয়েছেন বিজেপি’র বিধানসভার পরিষদীয় দলনেতা শংকর ঘোষ। তাঁর বক্তব্য, ‘শিলিগুড়ি শুধু উত্তরবঙ্গ নয়, উত্তর-পূর্ব ভারতের ভরকেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে। সেকথা বারবার বলেছি। প্রাসঙ্গিক বলেই প্রায় সব মহল থেকেই সময়ের সঙ্গে শিলিগুড়িকে দ্বিতীয় রাজধানী করার দাবি উঠেছে। গুরুত্ব দিয়ে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ওই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার।’
কংগ্রেস নেতা শংকর মালাকার শিলিগুড়িকে দ্বিতীয় রাজধানী করার পক্ষে জোর সওয়াল করে থেমে থাকেননি। ওই দাবিতে আন্দোলন করার বার্তাও দিয়েছেন। শংকরের কথা, ‘বিধায়ক থাকাকালীন বিধানসভার ভেতরে বারবার শিলিগুড়ির প্রশাসনিক গুরুত্ব বৃদ্ধির দাবি তুলেছিলাম। কোনও ভেদাভেদ না রেখে উত্তরবঙ্গের স্বার্থে সকলের এক হয়ে শিলিগুড়িকে দ্বিতীয় রাজধানী করার দাবিতে সোচ্চার হওয়া দরকার।’ দ্বিতীয় রাজধানীর প্রশ্নে কৌশলী উত্তর দিয়েছে সিপিএম। দলের নেতা ও প্রাক্তন মন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্য এখনই বিষয়টি নিয়ে মন্তব্য করতে চাননি। দলের দার্জিলিং জেলা সম্পাদক সমন পাঠকের বক্তব্য, ‘আমরা পরিকল্পিতভাবে মানুষের উন্নয়ন চাই। ভোটের রাজনীতির চমক নয়। সঠিক পরিকল্পনা থাকলে রাজধানী হল কী হল না তাতে উন্নয়ন আটকে থাকে না।’