পারমিতা রায়, শিলিগুড়ি : কেউ আসেন বাঘ দেখতে, কেউ বা হাতির পিঠে চড়তে। অনেকে আবার শুধুই ঘুরে বেড়ান প্রকৃতির মাঝে। তাঁকেও বেঙ্গল সাফারিতে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। তবে তিনি খোঁজ করেন ছোট্ট থেকে বড়দের, প্রত্যেকের মাঝে হারিয়ে যেতে, সৃষ্টি সুখের উল্লাসে। সৃষ্টি বলতে, বন্যপ্রাণ নিয়ে কবিতা, ছড়া, নানান গল্প। তিনি বেঙ্গল সাফারির অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপারভাইজার জনার্দন চৌধুরী। অনেকের কাছেই মনে হতে পারে, সকলকে নিজের লেখা শুনিয়ে কৃতিত্ব আদায় করতে চান তিনি। একদম নয়। তাঁর খেয়ালে থাকে বন্যপ্রাণ সম্পর্কে মানুষের মধ্যে ভালোবাসা, সচেতনতা গড়ে তোলা। যে কারণে এখন তাঁর পাশের ভিড়টা ভারী হচ্ছে।
শরীরে একাধিক ক্ষতচিহ্ন। চিহ্নগুলি তাঁর কর্মজীবনের প্রাপ্তি। কেননা, কখনও হাতির হামলার মুখে পড়তে হয়েছে, তো কখনও আবার বাইসনের। কিন্তু পিছিয়ে আসেননি, বরং বন্যপ্রাণদের ভালোবেসে ফেলেছেন। সেই ভালোবাসার লড়াইয়ের কথাই তিনি নানান ভাবে তুলে ধরছেন মানুষের কাছে। মাদারিহাটের বাসিন্দা জনার্দন কখনও সাফারিতে থাকা হাতিদের নিয়ে মজার গল্প বলেন, কখনও আবার বাঘ মামার জীবনকে কবিতার মাধ্যমে তুলে ধরেন। ষাটোর্ধ্ব জনার্দন অবসর নিয়েছিলেন ২০২২ সালে। কিন্তু বাড়িতে মন টেকেনি। তাই রাজ্য জু অথরিটির থেকে পুনরায় কাজ করার প্রস্তাব যখন পেলেন, তখন না করতে পারেননি। বর্তমান তাঁর কর্মস্থল শিলিগুড়ির অদূরে থাকা বেঙ্গল সাফারি।
এখানেই তিনি সকলকে বন্যপ্রাণের ‘পাঠ’ দেওয়ার চেষ্টা করছেন নিজের অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে। এর আগে যাঁরা তাঁর মুখে গল্প শুনেছেন, তাঁরা পুনরায় সাফারিতে এলে নাকি জনার্দনের খোঁজ করেন, বলছিলেন সাফারির অন্য কয়েকজন কর্মী। নতুনরাও খুশি মনে বাড়ি ফেরেন জনার্দনের গল্প শুনে। রবিবার পরিবারের সঙ্গে এখানে এসেছিল অনসূয়া দে, সৌমেন দে। সৌমেনের কথায়, ‘উনি ভীষণ ভালোভাবে সাফারি সম্পর্কে, এখানে থাকা নানান পশুপাখি সম্পর্কে আমাদের বুঝিয়েছেন। বন্যপ্রাণ সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য জানতে পেরেছি।’ গল্প শোনার ফাঁকে অনেকেই তাঁর হাতে থাকা ক্ষত সম্পর্কে জানতে চায়। তাঁকে বলতে শোনা যায়, ‘একসময় এক জংলি হাতির চিকিৎসা করতে গিয়ে কুনকির হামলার মুখে পড়ি। কুনকিটি দাঁত পেটে ঢুকিয়ে দেয়। দু’হাত দিয়ে দাঁত বের করার চেষ্টা করি। সুস্থ হতে টানা তিন মাস লেগে যায়।’
নিজে বারবার হামলার মুখে পড়েছেন। কিন্তু কোনও বন্যপ্রাণের মৃত্যুর খবর কানে এলে তাঁর চোখ ভিজে যায়। ২০১১ সালে কবিগুরু এক্সপ্রেসে সাতটি হাতির মৃত্যু সবচেয়ে বেশি কষ্ট দিয়েছিল, বললেন তিনি। জনার্দন বলেন, ‘একটি হাতি এমনভাবে ইঞ্জিনে আটকে ছিল যে, কেটে বের করতে হয়। সত্যিই ভয়ংকর অভিজ্ঞতা।’ যা এখনও মাঝে মাঝে তাঁর রাতের ঘুম কেড়ে নেয়। কিন্তু সকাল হলেই তাঁর মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, যখন তাঁর কবিতা-গল্পে হাসি খেলে যায় শিশু মনে।