শমিদীপ দত্ত, শিলিগুড়ি: সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ গৌরাঙ্গপল্লির মহাশক্তি স্পোর্টিং ক্লাবে চূড়ান্ত ব্যস্ততা (Siliguri)। এলাকার বাসিন্দাদের অশোক, বিজয়দের বলতে শোনা গেল, কিছুক্ষণ পরেই বরযাত্রী চলে আসবে। সামনের টিনের ঘরে তখন ছাঁদনাতলায় মন্ত্র পড়তে ব্যস্ত পুরোহিতমশাই। সেই মন্ত্র পাঠই একদৃষ্টে দেখছিল বছর দশের প্রতীক রায়। রোশনাইয়ের সঙ্গেই চারদিকে তখন বিয়ের বাজনার আওয়াজ। প্রতীক তার দিদার কাছে জানতে চায়, ‘বর আসবে কখন?’
কিছুক্ষণের মধ্যেই গাড়িতে করে হাজির হলেন বরযাত্রীরা। উলুধ্বনি, গেট ধরা সবকিছুই হল। কিন্তু বর কোথায়? প্রতীকের বারবার প্রশ্নের উত্তরে দিদা আঙুল তুলে দেখালেন, টিনের ঘরের ছাদের উপর বেরিয়ে আসা প্রকাণ্ড বট গাছের দিকে। বট গাছের গায়ে জড়ানো নতুন ধুতি। পাশেই পাকুড় বেনারসী গায়ে জড়িয়ে তখন নববধূ। সাতপাকে ঘুরতে না পারলেও নিয়মমতো অগ্নিসাক্ষী করেই তাদের বিয়ে হল। বিয়ের আয়োজকরাই সিঁদুরদান পর্ব সারলেন। বটপাকুড়ের বিয়েতে শুক্রবার সকাল থেকে গমগম করল ৪০ নম্বর ওয়ার্ডের গৌরাঙ্গপল্লি। বিয়ে দেখতে এলেন আশপাশের এলাকার বাসিন্দারাও।
ফোর লেনের কাজকে কেন্দ্র করে ইতিমধ্যেই কাটা পড়েছে একের পর এক গাছ। গাছ বাঁচানো নিয়ে চলেছে রাজনৈতিক তর্জা। এসবকিছুর মধ্যেই শুক্রবার সন্ধ্যায় আলো ঝলমলে পরিবেশে বটপাকুড়ের বিয়েতে ফুটে উঠল গাছের প্রতি এক দম্পতির অকৃত্রিম ভালোবাসা।
কুড়ি বছর আগে গৌরাঙ্গপল্লিতেই থাকতেন নিরঞ্জন রায় ও দেবিকা রায়। পরবর্তীতে হায়দরপাড়া সৎসঙ্গ মন্দিরের নিজেরা বাড়ি করে চলে আসেন। আসার আগে দেবিকার নজরে আসে, গৌরাঙ্গপল্লিতে ড্রেনের কাজের কারণে রাস্তার ধারে গজিয়ে ওঠা দুটি বট ও পাকুড় গাছ উপড়ে ফেলা হয়েছে। গাছ দুটিকে মহাশক্তি ক্লাবের একপাশে লাগিয়ে দেন তাঁরা। নিরঞ্জন-দেবিকা ঠিক করেন, গাছ দুটি পূর্ণবয়স্ক হলে তাঁরা বিয়ে দেবেন।
এদিন বাজনা-বিয়ের কোলাহল, ব্যস্ততার মধ্যেই কিছুটা একা অনুভব করছিলেন নিরঞ্জন। তিনি বলেন, ‘দেবিকা আর নেই। ২০২৩ সালে আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছে। স্ত্রীর মৃত্যুর পর এক বছর কাটতেই আমরা প্রস্তুতি শুরু করি বটপাকুড়ের বিয়ে দেওয়ার।’ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন ক্লাবের সদস্যরাও। পঞ্জিকা দেখে বিয়ের দিন ঠিক করার পর ১৫ দিন আগে শুরু হয় বিয়ের প্রস্তুতি। বরপক্ষ হয় চম্পাসারির এক পরিবার। কন্যাপক্ষ নিরঞ্জনের পরিবার। নিরঞ্জনের ছেলে বিপ্লব রায় ও তাঁর স্ত্রী রিয়া হন পাকুড়ের বাবা ও মা।
বিয়েতে অতিথি আপ্যায়নে ভোজের ব্যবস্থা না করলে হয়? তাই কন্যাপক্ষ আয়োজন করেছিল ভাত-ডাল-পাঁপড়-সবজি-মিষ্টি-পায়েসের। রবিবার আয়োজন হচ্ছে বৌভাতের। পাত্রী পাকুড়ের বাবা বিপ্লব বললেন, ‘ওইদিনও থাকছে একই ধরনের নিরামিষ মেনু।’ বটপাকুড়ের বিয়ে নিদর্শন হয়ে থাকল একে অপরের প্রতি ভালোবাসার।