মাম্পী চৌধুরী, শিলিগুড়ি: আনন্দময়ী কালীবাড়ির বাইরে সারিবদ্ধভাবে বসে রয়েছেন কয়েকজন মহিলা। পরনে আধময়লা শাড়ি। সবার চোখে চশমা। চোখেমুখে বলিরেখা স্পষ্ট। সম্বল বলতে এক-দুটো পুঁটুলি। দূর থেকে দেখেই বোঝা যায়, কারও বয়স আশি পেরিয়েছে, কারও আবার নব্বই ছুঁইছুঁই। জীবনসায়াহ্নে এসে যখন নাতিপুতির সঙ্গে খেলা করার কথা, তখন এই মানুষগুলো মন্দিরের বাইরে সারাদিন বসে কী করেন? ভিক্ষাবৃত্তি।
মন্দিরে আসা মানুষজনের সামনে হাত পাতেন তাঁরা। তাতে যতটুকু পাওয়া গেল, তা দিয়ে কোনওমতে পেট চলে বেণুবালা দাস, শুখবালা বর্মন, আরতি সূত্রধর, নয়নতারা সরকারদের। এই ভিড়ে শিলিগুড়ির (Siliguri) স্থায়ী বাসিন্দা যেমন রয়েছেন, তেমনই অন্য জেলা থেকে আসা বৃদ্ধারাও আছেন। এমনটা নয় যে তাঁদের সন্তান নেই। তবে সন্তানকে নিয়ে কথা বলতে গেলেই তাঁদের একসুরে খেদোক্তি শোনা যায়, এমন সন্তান থাকার চেয়ে না থাকাই ভালো!
নয়নতারাদের সঙ্গে কথা বললেই এই খেদোক্তির কারণ আন্দাজ করা যায়। তাঁরা সন্তানের সংসারে পুরোনো হয়ে গিয়েছেন। জামাকাপড়ের মতো। তাঁরা এখন ব্রাত্য। বাড়তি বোঝা। তাঁদের দায়িত্ব নিতে চান না সন্তানরা।
জীবনসায়াহ্নে এসে রোজগারের ক্ষমতা হারিয়েছেন আরতিরা। কিন্তু পেট তো সেসব শুনবে না। তাই সারাদিন মন্দিরের বাইরে বসে ভিক্ষা করেন তাঁরা। এটাই যেন তাঁদের ভবিতব্য।
কথা হচ্ছিল ৮০ বছরের নয়নতারার সঙ্গে। বাড়িতে তাঁকে দেখার কেউ নেই। ছেলে অনেক বছর আগে মারা গিয়েছেন। দুই দশক আগেও বেশ কর্মঠ ছিলেন নয়নতারা। লোকের বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করতেন। কিন্তু বয়সের ভারে সেই ক্ষমতা হারিয়েছেন। বয়স দেখে কেউ কাজ দিতে চান না। তাই গত ১০ বছর ধরে মন্দির চত্বরে ভিক্ষে করে পেট চালাচ্ছেন তিনি।
কোচবিহারের আরতি সূত্রধর, সুখবালা বর্মন ভাড়া থাকেন টিকিয়াপাড়ায়। পায়রার খোপের মতো ঘর। ভাড়া দিতেও রীতিমতো হিমসিম খান তাঁরা। কোচবিহারে স্বজন হারিয়েছেন দুজনে। তারপর থেকে এখানে এসে ভিক্ষাবৃত্তি করে দু’মুঠো ভাত জোগাড় করছেন তাঁরা। তবে সুখবালাদের জীবনে সুখ বলে কিছু নেই।
বেণু্বালার গল্পটা আরতিদের থেকে কিছুটা আলাদা। ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনি নিয়ে ভরা সংসার। কিন্তু বেণুবালা তাঁর নামটার মতোই পুরোনো হয়ে গিয়েছেন। তাই সংসারে তাঁর জায়গা হয়নি। মন খারাপ হয়? প্রশ্ন শুনে চোখের কোনায় জল আসে বৃদ্ধার। সাদা শাড়ির আঁচলটা দিয়ে চোখ মুছে বলেন, ‘বাচ্চাগুলোর জন্য মন খারাপ হয়।’ এর পরেও ছেলের বিরুদ্ধে কোনও ক্ষোভ নেই তাঁর। বলছিলেন, ‘ছেলে নিজেই সংসার টানতে হিমসিম খায়। আমি ওর সংসারে গিয়ে বাড়তি বোঝা হতে চাই না।’
শুধু যে মহিলারা ভিক্ষাবৃত্তি করছেন তা কিন্তু নয়। মাঝেমধ্যে দেখা মেলে বৃদ্ধের। এই যেমন গোপাল বর্মন। বয়স আশি পেরিয়েছে। কর্মক্ষমতা আর নেই। স্ত্রী গত হয়েছেন। সন্তানের সংসার রয়েছে। কিন্তু সেখানে জায়গা হয়নি তাঁর। তাই সহায় ‘ভগবান’।
সাধারণত বয়স্ক বাবা-মায়েদের বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানোর ট্রেন্ড লক্ষ করা যায়। তবে সেটা একমাত্র তাঁদের ক্ষেত্রেই সম্ভব, যাঁদের আর্থিক অবস্থা ভালো। যে সন্তানদের আর্থিক অবস্থা ভালো নয়, তাঁদের বাবা-মায়েদের ঠাঁই নিতে হয় মন্দিরের বাইরে।
আনন্দময়ী কালীবাড়িতে পুজো দিতে এসেছিলেন শুভঙ্কর কর্মকার। তাঁর মতে, ‘এই মানুষগুলোকে দেখার কেউ নেই। প্রশাসন যদি সাহায্য করে তবে কিছু একটা হতে পারে।’ একই বক্তব্য সিদ্ধেশ্বরী কালীবাড়িতে পুজো দিতে আসা সমীর বর্মনের। তাঁর কথা, ‘পুরনিগম এঁদের অন্ন-বাসস্থানের ব্যবস্থা করে দিলে ভালো হবে।’