শিলিগুড়ি : গাড়ি ভাড়া নিয়ে বিক্রি করে দেওয়ার চক্রে নাম জুড়ল জলপাইগুড়ি জেলা পরিষদের প্রাক্তন সদস্য পূজা কুজুরের। মেটেলির এই তৃণমূল নেত্রীর সঙ্গে ভুয়ো রাজনৈতিক পরিচয় দিয়ে যোগাযোগ করেছিলেন শিলিগুড়িতে গত বৃহস্পতিবার ধরা পড়া সোমনাথ মুখোপাধ্যায়। গত দুই বছরে পূজার কাছে তিনি ২৬টি গাড়ি বিক্রি করেছেন বলে অভিযোগ। সেই হিসেবে ২ কোটি টাকাও নিয়েছেন তিনি। পূজা এদিন দাবি করেছেন, ‘গাড়িগুলো একে একে মেটেলি থানার পুলিশের কাছে ফেরত দেওয়ার পর সোমনাথের সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল, সে আমাকে ২ কোটি টাকা ফিরিয়ে দেবে।’ চুক্তি হিসেবে সেই টাকা না দেওয়ায় সোমনাথের কলকাতার বাড়িতেও গিয়েছিলেন পূজা। যদিও সেখান থেকে তঁাকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। গত বছর সোমনাথ সহ তঁার তিন সঙ্গীর বিরুদ্ধে মেটেলি থানায় অভিযোগ দায়ের করেছিলেন ওই প্রাক্তন জেলা পরিষদ সদস্য। অভিযুক্তদের মধ্যে শিলিগুড়ির মেডিকেল মোড়ের বাসিন্দা হিসেবে পরিচয় দেওয়া দীপঙ্কর চক্রবর্তী ও অভিজিৎ পণ্ডিতও রয়েছেন।
সোমনাথের গ্রেপ্তার হওয়ায় প্রধাননগর থানার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে মেটেলি থানার পুলিশ। দীপঙ্কর ও অভিজিৎ অবশ্য পলাতক। তবে, সোমনাথের পর গত শনিবার ধরা পড়েছেন তাঁর তিন শাগরেদ নাগরাকাটার নীতেন প্রধান, রাজ নার্জিনারি ও বানারহাটের পাপ্পু ঝা। এঁদের কাছ থেকে ন’টি গাড়ি উদ্ধার হয়। সোমবার কামাত চ্যাংরাবান্ধার থেকে ধরা পড়েন সোমনাথের আরও এক শাগরেদ জাকির হোসেন। তাঁর কাছ থেকে ১০টি গাড়ি উদ্ধার হয়।
প্রাক্তন জেলা পরিষদ সদস্য পূজা মেটেলি থানার পুলিশকে জানিয়েছেন, স্থানীয় দুই বাসিন্দা সাইনামাজ মিয়ঁা ও বুদ্ধিমান প্রধান তঁার সঙ্গে সোমনাথের যোগাযোগ করে দিয়েছিলেন। তাঁরাই প্রথম গাড়ি কেনার ব্যাপারে পূজাকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন। সেক্ষেত্রে বলা হয়েছিল, ফিন্যান্স কোম্পানি থেকে এনওসি দিলেই গাড়ি তঁার নিজের নামে হয়ে যাবে। এজন্য অ্যাডভান্স দেওয়ার পর ছয় মাস সময় দিতে হবে। বিশ্বাসযোগ্যতার জন্য দুটি গাড়ি দিয়েও দেন সোমনাথ। পরবর্তীতে সেই গাড়ির সংখ্যা ২ থেকে বেড়ে ২৬ হয়ে যায়। এরমধ্যেই সাইনামাজ মিয়াঁ ও বুদ্ধিমান প্রধান জানান, গাড়ি ফেরত দিতে হবে। পূজা অভিযোগ করেছেন, ‘এরপরই সোমনাথকে ফোন করলে সে জানায়, কাগজপত্র সম্পর্কিত কিছু ত্রুটি ছিল। চিন্তার কিছু নেই, সমস্তটাই সে মিটিয়ে দেবে।’
পূজার আইনজীবী রূপেশ ছেত্রী বলেন, ‘আমার মক্কেলকে প্রতারিত করে এই গাড়িগুলি বিক্রি করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, অ্যাপের মাধ্যমে গাড়িগুলোর ভাড়ার ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে। গাড়িগুলো ফেরত দেওয়ার পর টাকা ফেরতের চুক্তি করলেও, সেই টাকা পর্যন্ত দেয়নি।’
পূজা আরও অভিযোগ করেছেন, সাকিলা ছেত্রী নামের এক মহিলার সঙ্গেও তঁার পরিচয় করে দিয়েছিলেন সোমনাথ। নিজের স্ত্রী হিসেবে পরিচয় দিলেও পরবর্তীতে পূজা জানতে পারেন, সাকিলা অন্য এক ব্যক্তির স্ত্রী। তিনি মারা গিয়েছেন। প্রধাননগর থানার পুলিশ সোমনাথকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পেরেছে, তিনি একাধিক বিয়েও করেছিলেন। বিয়ে করে স্ত্রীদেরও এই ব্যবসার কাজে ব্যবহার করতেন। শুধু তাই নয়, বেশ কয়েকটি জেলাতে তিনি এজেন্টও রেখেছিলেন।
সোমবার প্রধাননগর থানার পুলিশের একটি টিম কামাত চ্যাংরাবান্ধায় গিয়ে সোমনাথের এজেন্ট জাকির হোসেনকে গ্রেপ্তার করে। তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করে ওই এলাকার বিভিন্ন জায়গা থেকে আরও ১০টি গাড়ি উদ্ধার হয়েছে। এছাড়াও দুটি গাড়ি উদ্ধার হয়েছে শিলিগুড়ি থেকে। জাকিরকে মঙ্গলবার শিলিগুড়ি মহকুমা আদালতে তুলে হেপাজতে নিয়েছে প্রধাননগর থানার পুলিশ। এর আগে নাগরাকাটা থেকেও তিন এজেন্টকে গ্রেপ্তার করেছে প্রধাননগর থানা। থানার আইসি বাসুদেব সরকার বলেন, ‘অসম থেকেও বেশ কিছু গাড়ি চুরি করে এখানে আনা হয়েছে। আবার এখান থেকেও বেশ কিছু গাড়ি চুরি করে অসমে নিয়ে যাওয়ার সূত্র আমরা পেয়েছি। নেপালে দুটো গাড়ি জিপিএস-এর মাধ্যমে খোঁজ পেয়েছি। ভুটানেও গাড়ি গিয়েছে বলে আমার অনুমান করছি।’
পুলিশের অনুমান, ২০০-রও বেশি গাড়ি এই চক্র চুরি করেছে। এদিকে, এদিন প্রধাননগর থানায় অসম পুলিশ এসেও যোগাযোগ করে। অসম পুলিশের তরফে জানানো হয়েছে, চলতি মাসের প্রথম দিকে চঁাদমানি ও লতাসিল থানায় সব মিলিয়ে ১০ গাড়ি চুরির অভিযোগ জমা রয়েছে। এরমধ্যে পঁাচটি গাড়ি ইতিমধ্যেই উদ্ধার করেছে প্রধাননগর থানার পুলিশ।
শিলিগুড়ি মেট্রোপলিটান পুলিশের ডিসিপি (ওয়েস্ট) বিশ্বচঁাদ ঠাকুর বলেন, ‘এটা আন্তঃরাজ্য চক্র। আমরা ট্র্যাকিং করে গোটা গ্যাংকে ধরছি। তদন্ত করে, সমস্ত রহস্য উদঘাটন করা হবে।’