পারমিতা রায়, শিলিগুড়ি: সৌমিলি আর মৌমিতা দুই বোন। বাড়ি শিবমন্দিরে (Shivmandir)। বড়জনের বিয়ে হয়েছে বছরদশেক আগে। কোচবিহারে শ্বশুড়বাড়ি। মাঝেমধ্যে এখানে আসেন। বোনকে নিয়ে সন্ধ্যার পর বাড়ি থেকে বেরোলে অবাক হয়ে চারদিক দেখেন তিনি। সৌমিলি মৌমিতাকে বলছিলেন, ‘বিয়ের আগে অলিগলিগুলো কেমন একটা নিঝুম হয়ে থাকত রে বোন। খুব বেশি আলো ছিল না। তেমন কিছু খাবারও মিলত না। রাত গড়ালে বাইরে পা রাখতে বারণ করতেন বাবা।’
এই তো মাত্র এক দশক আগেকার কথা। তখন ফাস্ট ফুড বলতে সরোজিনী মাঠের ধারে ঠ্যালাগাড়িতে মোমো, চাউমিন আর কিছু ফুচকার দোকান বসত। তাছাড়া এশিয়ান হাইওয়ের পাশে কয়েকটি স্থায়ী দোকান ছিল। ব্যাস। তারপর কখন যেন কেউ জাদুর কাঠি ছুঁইয়ে দিল।
বাড়িতে অতিথি কিংবা বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আউটিং করতে গেলেও আগে যেতে হত শিলিগুড়ি। এখন শিবমন্দিরে খুলে গিয়েছে একাধিক রেস্তোরাঁ ও ক্যাফে। সুস্বাদু সব খাবার মেলে সেখানে। প্রশাসনিকভাবে গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকা হলেও সবদিক থেকেই শিবমন্দির শিলিগুড়ি শহরকে জোর টেক্কা দিচ্ছে এখন। স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্য বিনোদনের নিত্যনতুন সুযোগ তৈরি হচ্ছে তো বটেই, অন্য জায়গা থেকেও মানুষ যাচ্ছেন সময় কাটাতে। একটি ক্যাফে প্রথমে শিবমন্দিরে খোলার পর এতটা জনপ্রিয়তা পেয়েছিল যে, পরবর্তীতে তার একাধিক শাখা খোলা হয় শিলিগুড়িতে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল এক টাকার বার্গার, আনলিমিটেড চা ও ফুচকা। বোবা টি’র স্বাদে মজে পুরোনো থেকে নতুন প্রজন্ম।
মাটিগাড়ার ফ্লাইওভারের পর থেকে জায়গাটির রূপ বদলেছে অবাক গতিতে। সন্ধে নামার পর অন্ধকার মাখা গলিগুলো এখন ঝলমল করে আলোর রোশনাইয়ে। সরোজিনী মাঠে জমজমাট আড্ডা বসে রাত পর্যন্ত। পড়ুয়ারা আসে দলবেঁধে। মেজাজ হালকা করতে এটাই নাকি তাদের ‘মাস্ট ডেস্টিনেশন’। কথা হচ্ছিল নন্দিতা সাহার সঙ্গে। তিনিও পড়ুয়া। বললেন, ‘সন্ধ্যার পর আমরা একসঙ্গে হই। কখনও মাঠে আড্ডা বসে, কোনওদিন ক্যাফেতে গিয়ে বসি। আমাদের এখানে সুন্দর সুন্দর ক্যাফে, রেস্তোরাঁ খুলেছে। ইনস্টা-ফ্রেন্ডলি সব। সময় কাটাতে ভালো লাগে বেশ।’
মাঠের চারদিকে মোমো, চাউমিন পাওয়া যায় আগাগোড়া। নতুন কী? ফাস্ট ফুডের দোকানের সংখ্যা বেড়েছে। খুলেছে ক্যাফে। সেখানে বোবা টি, স্যান্ডউইচ, ফ্রায়েড চিকেন, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই পাওয়া যায়। কিছুটা এগিয়ে আরও বেশ কিছু খাবারের দোকান চোখে পড়বে। ফ্লাইওভার পেরোনোর পর একটি রেস্তোরাঁ। সেখানকার মেনুতে বিরিয়ানি সহ মোগলাই কুইজিনের হরেকরকমের পদ রয়েছে। এমন আরও অনেক ছোট-মাঝারি-বড় বিরিয়ানির দোকান খুলেছে।
বন্ধুরা ‘সোশ্যাল মিডিয়া কুইন’ বলে ডাকে অনুপ্রিয়া দত্তকে। শিলিগুড়ি শহরে শুধুমাত্র নতুন ধরনের খাবারের স্বাদ নিতে মাঝেমধ্যে আসেন তিনি। তারপর ছবি তুলে পোস্ট করেন সমাজমাধ্যমে। তাঁর তোলা ছবি দেখেই অনেকে সেসব জায়গায় খেতে যান। অনুপ্রিয়ার কথায়, ‘শিবমন্দিরে এখন অনেক ইনস্টা-ফ্রেন্ডলি ক্যাফে রয়েছে। ছবি তোলার জন্য আদর্শ। খাবারও দারুণ।’
একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের শাখার পাশে শংকর সরকারের দোকান। ‘এক টাকার বার্গার’ খেতে সেখানে ভিড় জমাচ্ছেন খাদ্যপ্রেমীরা। শিলিগুড়ি, গোঁসাইপুর এবং রানিডাঙ্গা থেকেও মানুষ আসছেন। শংকরের ব্যাখ্যায়, ‘১ টাকায় বার্গার বলা হয় ঠিকই, তবে শর্ত রয়েছে। ওই বার্গার খেতে হবে ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে। নয়তো পুরো দাম দিতে হয়। তাছাড়া আমার ক্যাফেতে সবকিছুই পকেট ফ্রেন্ডলি। কারণ, মূল খদ্দের পড়ুয়ারা।’
২৪ বছর বয়সি শংকরের মতো এলাকার আরও অনেকেই স্বাবলম্বী হয়েছেন বা হচ্ছেন অন্যের স্বাদ মিটিয়ে। ক্যাফে সজ্জা আর মেনুতে দেখা যাচ্ছে নতুন চিন্তাভাবনার ছোঁয়া। একই কথা শোনা গেল স্থানীয় তানিষ্ঠা রায়ের গলায়, ‘কমবয়সিদের কথা মাথায় রেখে দাম রাখা হচ্ছে সাধ্যের মধ্যে।’
সন্ধ্যায় প্রিয় মানুষের সঙ্গে সময় কাটানো হোক কিংবা বন্ধুদের সঙ্গে জমাটি আড্ডা- শিবমন্দিরের ছবিটা বদলে গিয়েছে ক্যাফে, রেস্তোরাঁর হাত ধরে।