রিমি শীল, কলকাতা: সদ্য নাইট ডিউটি শেষ করে ওয়ার্ড থেকে বেরোলেন জুনিয়ার চিকিৎসক মহুয়া পাঢি। দিনটা আরজি কর মেডিকেল কলেজে (RG Kar) হবু চিকিৎসককে ধর্ষণ-খুনের ঠিক এক বছর পর। এখনও কি রাত নামলে আতঙ্ক গ্রাস করে? একরাশ ক্লান্তি নিয়ে মহুয়া বলেন, ‘না, ওয়ার্ডের বাইরে রাতে সিআইএসএফ বারবার টহল দেয়।’ কথাটার সত্যতা বোঝা গেল মূল প্রবেশদ্বার থেকে ভিতরে ঢুকে ইতিউতি তাকিয়ে। সর্বত্র রয়েছে কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানদের ঘোরাঘুরি। বহির্বিভাগ, জরুরি বিভাগ সহ প্রতিটি বিল্ডিংয়ের বাইরে অন্তত ৪ থেকে ৫ জন জওয়ান মোতায়েন।
বেলা পড়তে বহির্বিভাগে রোগীর চাপ কমেছে। কিন্তু টহলদারিতে খামতি নেই। সরু গলির মধ্যে হস্টেল, রাত্রিনিবাস সহ হাসপাতালের সব কোনায় দেখা গেল তাঁদের। এই জওয়ানদের ভারী বুটের শব্দ এখন যেন মহিলা চিকিৎসক ও নার্সদের ভরসা, আস্থা। বছর খানেক আগে কলকাতার এই খ্যাতনামা হাসপাতালের ছবিটা এমন ছিল না বলেই তো ধর্ষণের পর খুন হয়েছিলেন এক তরুণী।
২০২৪ সালের ৮ অগাস্ট ওই রাতের সেই ঘটনার পর হাইকোর্টের নির্দেশে দীর্ঘদিন মোতায়েন রয়েছে সিআইএসএফ। পুলিশি নজরদারিও কম নয়। কারও কার্যকলাপই তাঁদের নজর এড়ায় না। স্বস্তি ফুটে ওঠে মহিলা চিকিৎসক ও নার্সদের কথায়। নার্সিং পড়ুয়া রিমি মোহান্তি যেমন বললেন, ‘যেখানেই ডিউটি পড়ুক, এখন আর ভয় লাগে না।’ রাতে কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানদের দেখা যায়? একটুও সময় না নিয়ে জবাব, ‘হ্যাঁ, সন্ধের পর থেকে ওঁরা ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে ঘুরে দেখেন।’
এক বছরে আরজি কর অনেক বদলে গেলেও দেওয়ালে দেওয়ালে লেখা ‘জাস্টিস ফর আরজি কর’, ‘অভয়ার বিচার চাই’ ইত্যাদি স্লোগান এখনও ওই রাতের বিভীষিকাকে মুছতে দেয়নি। অ্যাকাডেমিক বিল্ডিংয়ের পাশে গলায় স্টেথোস্কোপ ঝুলিয়ে মোবাইল দেখতে দেখতে যাচ্ছিলেন জুনিয়ার চিকিৎসক (পিজিটি) কৃতিকা সাহা। এক বছরে কী বদল দেখলেন? অদূরে বসে থাকা ৬ জন জওয়ানকে দেখিয়ে কৃতিকা বললেন, ‘দেখছেন না, ওঁরা সারাদিন থাকেন। ভয় কী। ওঁদের শিফট বদল হয়। তবে দফায় দফায় নজরদারি চালিয়ে যান। পান থেকে চুন খসলেই প্রশ্ন করেন।’
এখন হাসপাতাল চত্বরে ২৯৩ জন নিরাপত্তারক্ষী মোতায়েন। চিকিৎসক অনীশা লাখরি বললেন, ‘আমাদের জন্য আলাদা বিশ্রামঘর রয়েছে। এখন রাতে সব জায়গায় আলো থাকছে। বাড়তি আলোর ব্যবস্থা হয়েছে।’ সিসিটিভির সংখ্যা বেড়ে এখন ৫৩২। তবে কিছু জায়গায় এখনও অতিরিক্ত সিসি ক্যামেরা বসেনি। আরজি কর আন্দোলনের অন্যতম মুখ অনিকেত মাহাতো বললেন, ‘হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম তলায় এখনও পর্যাপ্ত সিসিটিভি নেই। মেইন হস্টেলে একই অবস্থা। তবে প্রসূতি বিভাগ, শিশু বিভাগ সহ কিছু জায়গায় পর্যাপ্ত সিসি ক্যামেরা রয়েছে।’ জরুরি বিভাগ যেন দুভের্দ্য এলাকা। সামনে গেলেই জওয়ানদের হাজারো প্রশ্ন। হাসপাতালের ট্রমা কেয়ারে আসা সকলের দিকে কড়া নজরদারি জওয়ানদের। মেডিকেল কলেজের ভিতর ধর্ষণ-খুনের বিচারের দাবিতে যে অস্থায়ী প্রতিবাদ মঞ্চ গড়ে উঠেছিল, যেখান থেকে সরকারের ভিত নাড়িয়ে দেওয়া স্লোগান উঠত, সেখানে কাউকে দেখা গেল না। শুধু অভয়ার প্রতীকী ছবিতে মালা পরানো। সামনে রাখা থালায় কিছু ফল। অনেকে আসছেন। কিছু না কিছু উপহার ছবির সামনে রেখে যাচ্ছেন।
সেই অস্থায়ী মঞ্চের কাছে অন্তত চারজন জওয়ান দাঁড়িয়ে। ছবির সামনে কে কী রেখে যাচ্ছেন, তা-ও দেখে নিচ্ছেন। সঙ্গে রয়েছেন পুলিশকর্মীরা। ঠিক এক বছর পরের দিনটায় শুক্রবার নিরাপত্তার ঘেরাটোপ কয়েকগুণ বেশি। যাঁরা সেসময় প্রতিবাদে অংশ নিয়েছিলেন, তাঁরা এখন ব্যস্ত নিজস্ব জগতে।
আন্দোলন কি তাহলে ফিকে হল? প্রতিবাদী চিকিৎসকদের অন্যতম অনিকেত মাহাতো বলেন, ‘যে কোনও আন্দোলনের ইতিহাস ঘেঁটে দেখলেই বুঝবেন, সময়ের সঙ্গে তা স্তিমিত হয়। কেউ কি কাজ ফেলে সারাদিন আন্দোলন করেন?’ তাহলে প্রতিবাদের অভিমুখ কি বদলাল? অনিকেতের উত্তর, ‘আমাদের দাবিই ছিল বিচার ও স্বাস্থ্যক্ষেত্রে দুর্নীতির প্রতিকার। কিছু জায়গায় আমরা সফল। তা বলে আন্দোলন নিভে যায়নি।’