উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: বধূ নির্যাতন রুখতে ভারতীয় দণ্ডবিধিতে ৪৯৮এ (SECTION 498-A) ধারা একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে। এই ধারার মাধ্যমে বিবাহিত মহিলাদের তাঁদের স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির সদস্যদের দ্বারা অত্যাচারের হাত থেকে আইনি সুরক্ষা প্রদান করা হয়। কিন্তু সম্প্রতি এই আইনের অপব্যবহারের বেশ কিছু অভিযোগ উঠেছে, যেখানে মিথ্যা অভিযোগের ভিত্তিতে বহু পুরুষ ও তাঁদের পরিবার হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এই বিষয়টি বর্তমানে একটি উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আসুন, কয়েকটি বাস্তব উদাহরণ এবং আইনি পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে এই সমস্যাটি খতিয়ে দেখা যাক।
ঘটনা ১: তথ্যপ্রযুক্তিকর্মীর আত্মহত্যা (বেঙ্গালুরু, ডিসেম্বর ২০২৪)
ডিসেম্বর ২০২৪ সালে বেঙ্গালুরুতে ৩৪ বছর বয়সি এক তথ্যপ্রযুক্তিকর্মীর আত্মহত্যার ঘটনা ৪৯৮এ ধারার অপব্যবহার নিয়ে ফের একবার প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। যদিও এই ঘটনার বিস্তারিত তথ্য এখনও প্রকাশ্যে আসেনি, তবে প্রাথমিকভাবে মনে করা হচ্ছে যে পারিবারিক কলহের জেরে তাঁর বিরুদ্ধে বধূ নির্যাতনের অভিযোগ দায়ের করা হয়েছিল এবং সেই কারণে তিনি চরম পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হন। এই ঘটনা আবারও প্রমাণ করে যে ৪৯৮এ ধারার মিথ্যা অভিযোগ একজন মানুষের জীবন কেড়ে নিতে পারে।
ঘটনা ২: পাঁচ বছরের আইনি লড়াইয়ের পর মুক্তি (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক)
সম্প্রতি ইকোনমিক টাইমসের একটি প্রতিবেদনে একটি ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে, যেখানে এক ব্যক্তি দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে ৪৯৮এ, পণপ্রথা বিরোধী আইন এবং এসসি/এসটি আইনের মিথ্যা অভিযোগের বিরুদ্ধে লড়াই করার পর অবশেষে সুপ্রিম কোর্ট থেকে স্বস্তি পেয়েছেন। আদালত স্পষ্টভাবে জানায় যে ফৌজদারি আইনকে যেন হয়রানি বা ব্যক্তিগত প্রতিশোধ নেওয়ার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা না হয়। অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ের পরেই যেন কোনও ব্যক্তিকে ফৌজদারি বিচারের সম্মুখীন করা হয়। এই ঘটনা আইনের অপব্যবহারের একটি জ্বলন্ত উদাহরণ।
আইনি পর্যবেক্ষণ:
৪৯৮এ ধারার অপব্যবহার নিয়ে বিভিন্ন সময়ে দেশের শীর্ষ আদালত উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
সুশীল কুমার বনাম ভারত সরকার (২০০৫): এই মামলায় সুপ্রিম কোর্ট ৪৯৮এ ধারার বহু মামলার উল্লেখ করে, যেখানে ব্যক্তিগত বিদ্বেষ থেকে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। আদালত এই ধরনের মিথ্যা অভিযোগের মোকাবিলা করার জন্য উপযুক্ত পদক্ষেপ করার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেয় এবং এটিকে “আইনি সন্ত্রাসবাদ” বলেও অভিহিত করে।
অর্ণেশ কুমার বনাম বিহার রাজ্য: এই গুরুত্বপূর্ণ মামলায় আদালত ৪৯৮এ ধারাকে একটি জামিন অযোগ্য এবং cognizable অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করে জানায়, প্রায়শই অসন্তুষ্ট স্ত্রীরা এটিকে সুরক্ষা কবচ না বানিয়ে বরং স্বামীর ও তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। এর ফলস্বরূপ বহু ক্ষেত্রে অসুস্থ বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদেরও উপযুক্ত প্রমাণ ছাড়াই গ্রেপ্তার করা হয়, যা অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়।
অচীন গুপ্ত বনাম হরিয়ানা রাজ্য: এই মামলায় বিচারপতি জে বি পারদিওয়ালা এবং মনোজ মিশ্র হুঁশিয়ারি দেন যে স্ত্রীর পরিবার বা বন্ধুদের প্ররোচনায় স্বামীকে চাপ দেওয়ার জন্য যেন পুলিশি ক্ষমতার অপব্যবহার না করা হয়।
পশ্চিমবঙ্গের প্রেক্ষাপট:
পশ্চিমবঙ্গেও ৪৯৮এ ধারার অপব্যবহারের অভিযোগ নতুন নয়। আইনজীবীরা এবং সমাজকর্মীরা প্রায়শই এই বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে থাকেন। পারিবারিক কলহ বা বিবাহ বিচ্ছেদের মতো পরিস্থিতিতে অনেক সময় মহিলারা রাগের বশে বা শ্বশুরবাড়ির উপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য এই ধারার অপব্যবহার করে থাকেন বলে অভিযোগ। এর ফলে বহু নির্দোষ পুরুষ এবং তাঁদের পরিবার দীর্ঘ আইনি জটিলতায় জড়িয়ে পড়েন এবং সামাজিক stigma-এর শিকার হন।
প্রতিরোধের উপায়:
৪৯৮এ ধারার অপব্যবহার রোধ করার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন:
প্রাথমিক তদন্ত: পুলিশের উচিত অভিযোগ দায়ের হওয়ার পর দ্রুত এবং নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করা। শুধুমাত্র অভিযোগের ভিত্তিতে সঙ্গে সঙ্গে গ্রেপ্তার না করে, অভিযোগের সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন।
আদালতের ভূমিকা: ম্যাজিস্ট্রেটদের উচিত অভিযোগের প্রাথমিক সারবত্তা খতিয়ে দেখা এবং শুধুমাত্র জোরালো প্রমাণ পাওয়ার পরেই অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে সমন জারি করা।
সচেতনতা বৃদ্ধি: মহিলা এবং পুরুষ উভয়ের মধ্যেই এই আইনের সঠিক ব্যবহার এবং অপব্যবহারের কুফল সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।
মধ্যস্থতা: পারিবারিক কলহের ক্ষেত্রে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার আগে মধ্যস্থতার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা উচিত।
৪৯৮এ ধারা নিঃসন্দেহে বিবাহিত মহিলাদের সুরক্ষার জন্য একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় আইন। তবে এর অপব্যবহার সমাজের একটি অংশে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করছে। একদিকে যেমন মহিলাদের অত্যাচারের হাত থেকে রক্ষা করা জরুরি, তেমনই অন্যদিকে মিথ্যা অভিযোগের ভিত্তিতে কোনও নির্দোষ ব্যক্তি যেন হয়রানির শিকার না হন, সেদিকেও নজর রাখা প্রয়োজন। একটি সুস্থ ও ন্যায়সঙ্গত সমাজ গঠনে আইনের সঠিক প্রয়োগ এবং অপব্যবহার রোধ করা উভয়ই অপরিহার্য।