Rangdar robbar | শৃঙ্খলার সঙ্গে কোনও বিরোধ নেই

Rangdar robbar | শৃঙ্খলার সঙ্গে কোনও বিরোধ নেই

ব্যবসা-বাণিজ্যের /BUSINESS
Spread the love


  • অরুণাভ রাহা রায়

কবি শামসুর রহমান লিখেছিলেন ‘স্বাধীনতা তুমি রোদেলা দুপুরে মধ্যপুকুরে গ্রাম্য মেয়ের অবাধ সাঁতার’। দৃশ্যটি ভাবলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে গ্রামীণ পুকুরের জলে এক কিশোরীর ভেসে বেড়ানোর ছবি। মতি নন্দীর উপন্যাসে পড়েছিলাম ফুটবল খেলতে নামার আগে শোভাবাজারের গঙ্গায় আধ ঘণ্টা সাঁতার কাটত দলের সদস্যরা। যাতে মাঠে নামলে শরীর হালকা লাগে। অর্থাৎ একটা নির্দিষ্ট সময় জলে ভেসে বেড়ালে তা শরীর ও মন- দুইয়ের পক্ষেই উপযোগী। কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত সাঁতার কাটলে তা চলে যাবে শরীরের বিপক্ষে। নিজেকে জলের মধ্যে বেশিক্ষণ ডুবিয়ে রাখাও তো ভালো নয়! কলেজ স্ট্রিটে বসবাসের সময় প্রায়ই গোলদিঘির ধার দিয়ে ঘুরতাম। অনেকে সাঁতার শিখতে আসত দেখতাম। সেখানে নামী সাঁতার প্রশিক্ষণকেন্দ্র আছে। তবে গরমকালে যেমন সাঁতারের রমরমা দেখা যেত, পাশাপাশি পুজোর পর থেকেই গোলদিঘির জল উধাও হয়ে যেত। কেননা শীতকালের ঠান্ডা জলে সাঁতার কাটা শরীরের জন্য মোটেও নিরাপদ নয়।

সাহিত্যিক বুদ্ধদেব গুহ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, তাঁর জীবন তিনি ট্রেনের কম্পার্টমেন্টের মতো ভাগ করে নিয়েছেন। সারাদিনের একটা নির্দিষ্ট সময় তিনি লেখেন, কখনও তিনি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট, আবার কখনও গায়ক বদ্ধদেব গুহ, ছবি আঁকার সময় তিনি চিত্রকর। আর কম বয়সে যখন রাইফেল হাতে বাঘ মারতে যেতেন, তখন তিনি শিকারি। তাঁর একাধিক লেখায় আমরা শিকারের রেফারেন্স পেয়েছি, পেয়েছি জঙ্গলের কথাও। কিন্তু কেন তিনি ট্রেনের কম্পার্টমেন্টের মতো জীবনকে ভাগ করে নিয়েছিলেন? আজ মনে হয়, দিনভর সময়কে ঠিকমতো কাজে লাগানোর জন্য। আমার পেশা যাতে আমারই নেশার সঙ্গে সংঘর্ষে না জড়ায়, আবার আমার নেশা যাতে আমার পেশাকে মেরে ফেলতে না-পারে, সে জন্যই বোধ হয় এ ব্যাপারে নিজে থেকে পরিমিত ও পরিশীলিত হতে পারলে ভালো।

কবি আলোক সরকারের একটি লেখায় পড়েছিলাম, ‘যে কোনও প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের প্রতি আনুগত্য মানুষের ব্যক্তিত্বের বিকাশকে খণ্ডিত করে।’ একদা কথাটি আমাকে খুব ভাবিয়েছিল। নিজের ভেতরে যা কিছু ভালো আছে কিংবা মন্দ, তা ঠিকমতো বিকশিত হবে না যদি আমি কোনও প্রতিষ্ঠানের ধর্মকে অন্ধভাবে অনুসরণ করে চলি। সত্যজিৎ রায় এক বালকের আঁকার খাতা দেখে তার অভিভাবককে বলেছিলেন, ওকে নিজের মতো আঁকতে দেবেন। অর্থাৎ বালক-মনে যা কিছু আছে সম্পাদনাহীনভাবে তা যেন উঠে আসে আঁকার খাতায়। যাতে সে নিজের মনকে বিকশিত করতে পারে। তবে একটা সময়ের পর নিজেকেও সম্পাদনা করা জরুরি হয়ে পড়ে। যে সমাজে আমরা বাস করি সেখানেও তো অবাধ স্বাধীনতা নেওয়ার সুযোগ থাকে না। আর প্রয়োজনের বেশি স্বাধীন হওয়ার দরকারই বা কী! মাত্রাতিরিক্ত স্বাধীনতা যেন আমাদের জীবনের শৃঙ্খলা বিঘ্নিত করতে না-পারে।

স্কুলবেলার দুই বন্ধুর কথা মনে পড়ে। আদতে দুই ভাই তারা। পাড়ার দোকানে মাসিক খাতার বন্দোবস্ত করে দিয়েছিলেন তাদের বাবা। সারাদিন দেখতাম দুই ভাই চিপস আর ক্যাডবেরি খাচ্ছে। দোকানদার হিসেব লিখে রাখছে সেই খাতায়। আমাকেও দোকানে নিয়ে গিয়ে এসব খাওয়াত এই দুই বন্ধু। কিছুদিন পর জানা গেল বেশি বেশি চিপস আর ক্যাডবেরি খেয়ে তাদের শরীরের অবস্থা বেহাল! আর এ কারণেই সেই মাসিক খাতা বন্ধ করে দিয়েছেন তাদের বাবা। এ তো ভালোর জন্যই করা! এতে কখনোই বলা যায় না যে তাদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেছে পরিবার! এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে নিশ্চয়ই দুই ভাই বাবার বিরুদ্ধে শ্লোগান দেয়নি : ‘স্বাধীনতা-হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে, কে বাঁচিতে চায়?’

স্কুলবেলার ক্লাস ক্যাপ্টেনরা দু’টি ক্লাসের মধ্যবর্তী বিরতিতে পাহারা দিত দরজায়। ফাঁকফোকর পেলেই আমরা বাইরে গিয়ে ফুচকা খেয়ে আসতাম। খেতে যেতাম বারোমিশালি। কিন্তু যে নিয়ম প্রত্যেক পড়ুয়াকেই মেনে চলতে হত তা হল ক্লাস-ক্যাপ্টেনদের অনুশাসন। যার কাঠামো তৈরি করে দিয়েছিলেন আমাদেরই শিক্ষকরা। যাতে আমরা কেউই বেশি স্বাধীন হয়ে গিয়ে প্রয়োজনের অধিক সুবিধা ভোগ করে না ফেলি। কেননা বেশি সুবিধা পেলেই বিগড়ে যাওয়ারও সম্ভাবনা থাকে। জীবনের ক্ষেত্রেও এ বাক্য কার্যকর। সুবিধা পেলামই-বা অনেক, তা যদি সদর্থে কাজে লাগানো যায় নিজেকে শৃঙ্খলায় রেখে, তাহলে নিঃসন্দেহে সেটা হয়ে ওঠে জীবনের জন্য উপযোগী।

স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে যখন কলকাতায় পড়তে এলাম, কলেজ স্ট্রিটের বেশ কিছু বোর্ডিং আর মেসবাড়িতে আমাকে থাকতে হয়েছে। সেখানেও পেয়েছি বাড়িওয়ালাদের অনুশাসন! বিধান সরণির মেসবাড়িতে রাতে ঢুকে পড়তে হত ১০টার মধ্যে। আড্ডায় কোনও কোনও বন্ধু এ নিয়ে খানিক ঠাট্টা করে বলেছিল কলকাতা শহরে রাত ১০টা মানে সন্ধে। কিন্তু এ মন্তব্য প্রভাবিত করতে পারেনি আমাকে। বরং নিয়মানুবর্তিতা সম্পর্কে সচেতন করেছিল। আজ যখন পাকেচক্রে ঘুরে মেসবাড়ি ছেড়ে যাদবপুরের ভাড়াবাড়িতে ঠাঁই নিয়েছি, তখনও রাত সেই ১০টায় বাড়ি ফেরার অভ্যাসই রয়ে গিয়েছে আমার মধ্যে।

এরপর আসি কর্মজীবনের কথায়। আমাদের প্রত্যেকেরই এক্ষেত্রে মেনে চলতে হয় বেশ কিছু নির্দেশনা। একাধিক কর্পোরেট হাউসে কাজ করতে গিয়ে বিচিত্র অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছি। মস্ত বড় কাচের দরজা, চা খেতে বের হলেও কার্ড পাঞ্চ করে বের হতে হত। আমি কতক্ষণের জন্য বাইরে বেরিয়েছি, তা ধরা থাকত অ্যাপে। কার্ড মেশিনে না-ছোঁয়ালে কাচের ফটক খুলত না। এ ক্ষেত্রেও এক বিদেশি বন্ধু মন্তব্য করেছিল– এ যেন একেবারে দাস প্রথা! অর্থাৎ ছোটবেলার পাঠক্রমে যেমনটা আমরা পড়েছিলাম, প্রাচীন ও মধ্যযুগে একশ্রেণির মানুষের কোনও স্বাধীনতা ছিল না। মালিকের ইচ্ছে অনুযায়ী কাজ করতে হত। তবে বিদেশি বন্ধুর এমন ইঙ্গিত আমাকে প্রভাবিত করতে পারেনি বিশেষ! কেননা আমার মনে পড়েছিল এক বিখ্যাত সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদকের কথা। কলেজ জীবনে তাঁর অফিসে গিয়েছিলাম। খানিক আড্ডার পরে তিনি আমার সঙ্গে দোতলা থেকে নীচে নেমে এলেন চায়ের দোকানে। তারপর আমার সঙ্গে চা খেতে খেতে গল্পও করলেন আধ ঘণ্টা। ফের অফিসে ঢুকে পড়ার আগে বললেন, এবার আমাকে আরও আধ ঘণ্টা বেশি থাকতে হবে অফিসে! এটাই নিয়ম। স্বাধীনতার সঙ্গে শৃঙ্খলের বিরোধ থাকতে পারে। কিন্তু শৃঙ্খলার সঙ্গে তো স্বাধীনতার কোনও দ্বন্দ্ব নেই! বরং অবাধ স্বাধীনতাই আমাদের করে তুলতে পারে উচ্ছৃঙ্খল।

আমরা জানি ডুয়ার্সে খুব বৃষ্টি হয়। বেশি বৃষ্টি প্রকৃতির জন্য উপযোগী নয়, এও আমরা জানি। বেঁচে থাকতে বৃষ্টি দরকার, কিন্তু অতি বেশি বৃষ্টি যে সামান্য তৃণকেও উচ্ছৃঙ্খল করে দিতে পারে তা আমরা জেনেছি কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা পড়ে—‘বৃষ্টিতে ডুয়ার্স খুব পর্যটনময়…/ ঘাস বড় উচ্ছৃঙ্খল এখন এখানে… ।



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *