সৌরভ রায়, ফাঁসিদেওয়া: অনলাইনে সহজ আয়ের পথ খুঁজতে গিয়েই জামাতাড়ার ধাঁচে শিলিগুড়ি (Siliguri) গ্রামীণ এলাকার ফাঁসিদেওয়ার (Phansidewa) চটহাটে অপরাধ সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিল মহম্মদ সইদুল। কারবারের কিংপিন সইদুলকে গ্রেপ্তার করার পর তদন্ত যত এগোচ্ছে একের পর এক নতুন তথ্য পুলিশের হাতে আসছে।
স্থানীয় বাজারে একটি মোবাইল ফোন বিক্রি ও মেরামতির দোকান চালালেও মোটা টাকা রোজগারের লোভ থেকেই দেশে প্রায় ৮০ কোটি টাকার বেশি সাইবার প্রতারণায় জড়িয়ে পড়ে সে। এখানেই শেষ নয়, তার কাছে প্রশিক্ষণ নিয়ে আরও বেশকিছু চক্র দেশজুড়ে এই জাল বিস্তার করে চলেছে। আর সেটাই পুলিশের কাছে চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, দিল্লি থেকে মোবাইল রিপেয়ারিং শিখে ভাড়া নিয়ে দোকান শুরু করে সইদুল। সেখানে মোবাইলের সিম কার্ডও বিক্রি করত সে। সেইসঙ্গে বিভিন্ন অনলাইন পরিষেবাও দিত। এরমাঝে গ্রামীণ এলাকার ফড়েদের সরকারি মূল্যে ধান বিক্রির টাকা তোলার জন্য অন্যের নামে থাকা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জোগাড় করে দিতে থাকে সইদুল। সেখান থেকেও ভালো রোজগার হচ্ছিল তার। কিন্তু আরও বেশি আয়ের লোভ পেয়ে বসে সইদুলকে। তখনই সে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ভাড়া দিয়ে আরও বেশি আয়ের অসৎ পথ খুঁজে নেয়।
পুলিশ জানিয়েছে, গোটা দেশ থেকে ন্যাশনাল সাইবার ক্রাইম পোর্টালে হওয়া ৩৪০টি অপরাধে যোগ রয়েছে সইদুলের চক্রের। রীতিমতো লোকজন রেখে বড় প্রতারণার চক্র গড়ে তোলে সইদুল।
এখন সে পুলিশের জালে থাকলেও, তার হাতেই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আরও ১০ থেকে ১২ জন মিলে সাইবার প্রতারণার কারবার চালিয়ে যাচ্ছে বলে পুলিশ সূত্রে খবর মিলেছে। তবে, ভারত-বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী একটি গ্রামে বসে দেশব্যাপী প্রতারণার এতবড় চক্র গড়ে তোলা শুধুমাত্র একা সইদুলের পক্ষে সহজ কাজ ছিল না। এর পিছনে রাজনৈতিক নেতাদের মদত ছিল বলেই অভিযোগ রয়েছে।
দিল্লি, মুম্বই, গুজরাট থেকে সইদুলের এই চক্রের যোগ ইতিমধ্যেই পুলিশ পেয়েছে। সেইসঙ্গে, তার ভাড়া নেওয়া ব্যাংক অ্যাকাউন্টগুলি দুবাই, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা থেকে ব্যবহারের তথ্য পেয়েছে পুলিশ। ফলে সইদুলের প্রতারণার জাল আন্তর্জাতিক স্তরেও ছড়িয়েছে, এনিয়ে তদন্তকারীরা নিশ্চিত।
পুলিশ এখনও পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত এবং বেসরকারি ব্যাংক মিলিয়ে সইদুলদের ব্যবহার করা হাজারেরও বেশি অ্যাকাউন্টের খোঁজ পেয়েছে। সেগুলির মাধ্যমে লেনদেনের আর্থিক পরিমাণ এবং অন্যান্য তথ্য এখন জানতে চাইছে পুলিশ। সেই সমস্ত অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করা গেলেও, ব্যাংকগুলি থেকে পুলিশের দাবিমতো তথ্য এখনও মেলেনি। ফলে ব্যাংকগুলির ভূমিকা নিয়ে সন্দেহ বাড়ছে। পুলিশ জানিয়েছে, সইদুল স্থানীয় মানুষের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ভাড়ায় নেওয়ার পাশাপাশি, অন্যের ছবি এবং আধার দিয়ে সিম অ্যাক্টিভ করত। এরপর ওই ব্যক্তির প্যান ব্যবহার করে ব্যাংককর্মীদের হাত করে অ্যাকাউন্ট খুলিয়ে এটিএম, পাসবই নিজের কাছে রাখত। ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা ভাড়ায় খাটত সেই ব্যাংক অ্যাকাউন্ট। তদন্তকারীদের ধারণা, ব্যাংককর্মীদের একাংশের সক্রিয় সহযোগিতা ছাড়া এভাবে অন্যের অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করা সইদুলের পক্ষে সম্ভব হত না।
পুলিশ মনে করছে, তদন্তে আর্থিক এই লেনদেনের পরিমাণ ২০০ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। দার্জিলিংয়ের পুলিশ সুপার প্রবীণ প্রকাশ নিজে এই দাবি করেছেন। বেটিং অ্যাপ এবং লোন অ্যাপের প্রতারণার টাকা এই সমস্ত অ্যাকাউন্ট মারফত লেনদেন হত। সমস্ত অপারেশন দুবাই থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছিল। বছর দুয়েক আগে সইদুল এই প্রতারণার কাজ শুরু করে। ২০২৪ সালে মে মাসে সেই ঘটনা প্রথম সামনে আসে।
প্রথমে সইদুলের সাগরেদ অনিল গোপ এবং ভাইপো মহম্মদ আনোয়ার গ্রেপ্তার হয়। চলতি বছর ৪ মার্চ পুলিশ সইদুল এবং তার আরেক সহযোগী তপন গোপকে গ্রেপ্তার করে। তাদের ছয়দিনের হেপাজতে নিয়ে জেরায় একের পর এক বিস্ফোরক তথ্য হাতে আসে পুলিশের।
তদন্তের স্বার্থে দুজনকেই মঙ্গলবার ফের শিলিগুড়ি মহকুমা আদালতে তুলে নিজেদের হেপাজতে নেওয়ার আর্জি জানালে বিচারক তাদের ছয়দিনের পুলিশ হেপাজতের নির্দেশ দেন।