এম আনওয়ারউল হক, বৈষ্ণবনগর: হঠাৎ যেন উৎসবের আবহ সুকদেবপুরে। প্রতিটি বাড়ি আত্মীয়পরিজনে গমগম করছে। আশপাশের গ্রাম তো আছেই, মুর্শিদাবাদ থেকেও গাড়িভর্তি লোকজন আসছেন সীমান্ত গ্রামে। সবাই ভীষণ সতর্ক। অনেকেই রাত জাগছেন। কিন্তু এরকম পরিস্থিতির কারণ কী? গ্রামবাসীর উত্তর, ‘আমাদের ফসল চুরি হচ্ছে। বিজিবির মদতেই ওপারের দুষ্কৃতীরা গ্রামে ঢুকছে। ফসল আমাদের মা। তাই ফসল বাঁচাতে প্রাণ দিতেও রাজি।’
মালদার (Malda Information) কালিয়াচক-৩ (Kaliachak) ব্লকের বাখরাবাদ পঞ্চায়েতের সুকদেবপুরের পাথর ছোড়াছুড়ির ঘটনার পর থেকেই ছবিটা বদলে গিয়েছে। সবাই ভীতসন্ত্রস্ত। নিরাপত্তার স্বার্থে বাসিন্দারা লোকবল বাড়ানোর জন্য নিজেদের আত্মীয়স্বজনদেরও ডেকে নিচ্ছেন। তৎপর বৈষ্ণবনগর থানার পুলিশও। ভিড় সামলানোর জন্য জায়গায় জায়গায় পিকেটিং বসানো হয়েছে।
জিরো পয়েন্ট এলাকায় বাংলাদেশি দুষ্কৃতীদের কিছুতেই আটকানো যাচ্ছে না বলে খবর। সব্দলপুর সুকদেবপুর সীমান্তে ফের মঙ্গলবার ও বুধবার সকালে ফসল চুরির ঘটনা ঘটেছে। আর এই ফসল চুরিতে মদত জোগাচ্ছে বিজিবির জওয়ানদের একাংশ। বিজিবির জওয়ানরা বাংলাদেশি দুষ্কৃতী ফসল চোরদের কাছে কখনও ১০০, তো কখনও ১৫০, ২০০ টাকা তুলছে বলে অভিযোগ। সুকদেবপুরের বাসিন্দাদের এমনই চাঞ্চল্যকর অভিযোগ। ওপারে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার খোকা সীমান্ত। সেখানে বিজিবির পোস্ট রয়েছে। বাংলাদেশের দুষ্কৃতীরা ওই পোস্ট দিয়েই ভারতীয় সীমানায় প্রবেশ করছে। মূলত ভারতীয় ভূখণ্ডের ফসল লুঠপাটের জন্য তারা সীমান্তে আসছে। সুকদেবপুরের বাসিন্দা ভূপেন সিনহার অভিযোগ, আবার দুদিন ধরে ফসল কেটে নিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের দুষ্কৃতীরা। আমরা বিএসএফকে সমস্ত বিষয় জানিয়েছি। আরেক বাসিন্দা ঝন্টু মণ্ডলের দাবি, ‘ভারত ভূখণ্ডে অনুপ্রবেশ, চোরাচালান ও লুঠপাট জারি রাখতেই বিএসএফকে কাঁটাতারের বেড়া দিতে বাধা দিচ্ছে বিজিবি। কাঁটাতারের বেড়া তৈরি হয়ে গেলে বাংলাদেশি দুষ্কৃতীদের লুঠতরাজ চালানো বন্ধ হয়ে যাবে। বিজিবির উপার্জন বন্ধ হয়ে যাবে। তাই বেড়া তৈরি করতে বাধা দিচ্ছে।’
তবে সব্দলপুর এলাকার বাসিন্দা সুখেন মণ্ডলরা প্রস্তুত। তাঁদের সাফ কথা, ‘কখন কী হয়, বলা তো যায় না। ৬ জানুয়ারির গণ্ডগোলের পর থেকেই আমরা নিজেদের আত্মীয়স্বজনদেরকে বিষয়টি জানিয়েছি। পরিজনরা নিরাপত্তার স্বার্থে আমাদের বাড়িতে এসেছেন। প্রত্যেক বাড়িতেই লোকজন থাকায় সাহস বেড়েছে আমাদের।’
সুখেনবাবুর সাফ কথা, ‘আমাদের ফসল যদি বাংলাদেশি দুষ্কৃতীরা নষ্ট করে, তবে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য প্রস্তুত রয়েছি।’
সুকদেবপুর গ্রাম থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে বীরনগরে বাড়ি প্রশান্ত দাসের। কথায় কথায় জানালেন, ‘প্রতিদিন সকাল হলেই ১০-১৫ জন করে চলে আসছি। এখানে আমাদের অনেকের আত্মীয় রয়েছে। বাংলাদেশের দুষ্কৃতীরা ফসল কেটে নিয়ে পালাচ্ছে, সেটাতে বিজিবির পরোক্ষ প্রতক্ষ মদত রয়েছে। আমাদের দেখে আরও অনেকে আসছে। বাংলাদেশের দুষ্কৃতীরা ফসল কাটতে যাতে না পারে আমরা সবরকমভাবে প্রস্তুত।’
ধুলিয়ান থেকে সীমান্ত গ্রামে এসেছেন কনক সরকার। তঁার অভিমত, ‘সুকদেবপুরের মানুষ কাঁধে কঁাধ মিলিয়ে লড়াইয়ের জন্য এসেছি।’
গাজোল থেকে সমর্থনের জন্য এসেছেন সন্দীপ সরকার। ক্ষোভের সঙ্গে তাঁর প্রতিক্রিয়া, ‘বাংলাদেশের দুষ্কৃতীরা অবৈধভাবে অনুপ্রবেশ করে ভারতীয়দের ফসল কেটে নিয়ে যাবে, তা মেনে নেব না। যোগ্য জবাব দিতে আমরা প্রস্তুত আছি।’
এদিকে, ভারতের বিএসএফ ও বাংলাদেশের বিজিবির মধ্যে ফ্ল্যাগ মিটিং হয়েছে। বিএসএফ ফ্ল্যাগ মিটিংয়ের পর দলবদ্ধভাবে জিরো পয়েন্ট এলাকায় ভারতীয় কৃষকদের যাতায়াতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। প্রচুর পরিমাণে নিজেদের সংখ্যাও উত্তরোত্তর বৃদ্ধি করেছে বিএসএফ। নিরাপত্তাও জোরদার করা হয়েছে সীমান্তে।
পুলিশ জানিয়েছে, প্রচুর পরিমাণে মানুষ আসছে দেখে আমরা এলাকায় পিকেটিং করেছি। মানুষ যাতে সীমান্ত এলাকায় জমায়েত না করে তার জন্য সচেতনতা তৈরি করতে চেষ্টা করছি।
উল্লেখ্য, মাসখানেক আগে পর্যন্ত সুকদেবপুর গ্রাম ছিল প্রত্যন্ত। জানুয়ারির শুরুতেই কাঁটাতার দেওয়া নিয়ে বচসার পর থেকে শিরোনামে উঠে এসেছে সীমান্ত গ্রামের এই নাম। কখনও বেড়া বাঁধা নিয়ে বিবাদ, কখনও ফসল, পাম্পসেট চুরি নিয়ে উত্তেজনা চরমে উঠেছে। বিএসএফ ও বিজিবির তরফে মিটিংও হয়েছে। কিন্তু চাপা উত্তেজনা কমেনি।