বাণীব্রত চক্রবর্তী, ময়নাগুড়ি : ময়নাগুড়ি গ্রামীণ হাসপাতালে চিকিৎসকের সংকট মারাত্মক আকার নিয়েছে। ইমার্জেন্সি বিভাগের একমাত্র ডাক্তারকে ইন্ডোরে রাউন্ডে যেতে হচ্ছে। ফলে হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে দেখাতে এসে সংকটজনক রোগীদের অপেক্ষা করতে হচ্ছে ঘণ্টাখানেক। বুধবার এমন ঘটনায় উত্তেজনা ছড়াল ময়নাগুড়ি গ্রামীণ হাসপাতালে।
তখন সকাল আটটা বেজে কয়েক মিনিট। ইমার্জেন্সিতে ডাক্তারের চেয়ার ফাঁকা। ডাক্তার দেখানোর জন্য অপেক্ষা করে রয়েছেন অন্তত কুড়িজন রোগী। এর মধ্যে ছিলেন ৭৪ বছর বয়সের এক হৃদরোগী। প্রবল শ্বাসকষ্টজনিত যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। প্রায় এক ঘণ্টা পর ইন্ডোর রাউন্ড সেরে ডাঃ শ্রীজিতা সাহা এসে বসেন ইমার্জেন্সি বিভাগের চেয়ারে। তাঁকে দেখেই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন দীর্ঘ সময় ধরে অপেক্ষা করা রোগীর পরিজনরা। বাস্তব পরিস্থিতি সম্পর্কে ডাক্তারই উত্তেজিত জনতাকে বুঝিয়ে বলেন। তারপর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়।
হাসপাতাল সূত্রে খবর, এমন ঘটনা নতুন কিছু নয়। মাঝেমধ্যেই এই ধরনের ঘটনা ঘটছে। ডাঃ সাহা বলেন, ‘মঙ্গলবার নাইট ডিউটি করে বুধবার ডিউটি চালিয়ে যেতে হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে ইন্ডোর রাউন্ড দেওয়ার কাজ। প্রয়োজনে লেবার ওয়ার্ডেও ডিউটি দিতে যেতে হচ্ছে একইসঙ্গে।’ ব্লক স্বাস্থ্য আধিকারিক ডাঃ সীতেশ বর বলেন, ‘ময়নাগুড়ি হাসপাতালে ছয়জন চিকিৎসক রয়েছেন। তিনজনকে ওপিডিতেই থাকতে হয়। ইমার্জেন্সিতে যিনি থাকেন তাঁকেই ইন্ডোর রাউন্ড এবং লেবার ওয়ার্ড দেখতে হয়। ১৯৯১ সালের সরকারি নির্দেশনামা অনুযায়ী চলছে ময়নাগুড়ি গ্রামীণ হাসপাতাল। সেই নির্দেশনামা অনুযায়ীও পরিকাঠামো নেই। কর্মী সংখ্যা অনেকটাই কম।’
স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে ২০১১ সালে ময়নাগুড়ি গ্রামীণ হাসপাতাল হয়। কিন্তু পরিবর্তন কেবলমাত্র সাইনবোর্ডেই হয়েছে। পরিকাঠামোগত কোনও পরিবর্তন হয়নি আজও। রোগীদের সংখ্যা কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বহির্বিভাগে গড়ে প্রতিদিন রোগীর সংখ্যা কমপক্ষে ৪০০। আসলে ভৌগোলিক কারণেই এই হাসপাতালে রোগীর চাপ বেশি। পরিকাঠামোগত সমস্যায় ধুঁকছে হাসপাতাল।
সমস্যার কথা মানতে নারাজ ময়নাগুড়ি শহর লাগোয়া বাগজানের বাসিন্দা নকুল দে সরকার। তিনি এদিন এক মাসের নাতনিকে নিয়ে ইমার্জেন্সিতে এসেছিলেন চিকিৎসার জন্য। প্রায় এক ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়েছে। প্রবল জ্বরে আক্রান্ত শিশুটি। নকুল বলেন, ‘পরিকাঠামোগত সমস্যার কথা শুনিয়ে কোনও লাভ নেই। কোনও রোগীর অঘটন ঘটে গেলে তার দায়ভার কে নেবেন?’ পুরসভার ১২ নম্বর ওয়ার্ড দেবীনগরপাড়ার বাসিন্দা পাপিয়া চৌধুরী এদিন সকাল আটটা নাগাদ তাঁর দাদা বরুণ চৌধুরীকে (৭৪) হাসপাতালে নিয়ে যান। দাদা শ্বাসকষ্টজনিত রোগে ভুগছিলেন। ফাঁকা ইমার্জেন্সিতে একটি বেডে বসে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত ওই সরকারি কর্মী। প্রায় এক ঘণ্টা অপেক্ষার পর তিনি চিকিৎসকের দেখা পান। পরে তাঁকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় জলপাইগুড়ি সুপারস্পেশালিটি হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। পাপিয়া বলেন, ‘মৃত্যু পর্যন্ত হয়ে যেতে পারত। মুমূর্ষু রোগীকেও এক ঘণ্টা বসিয়ে রাখা হয়েছে। ডাক্তার ইন্ডোরে রাউন্ডে গিয়েছেন। অধৈর্য হয়ে পড়ছিলাম।’ ৭ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা পেশায় শিক্ষক শ্যামল বিশ্বাস। তাঁরও একই অভিযোগ। মেয়ে পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী সপ্তদীপা বারবার বমি করছিল। সঙ্গে অসহ্য পেটব্যথা। শ্যামল বলেন, ‘হাসপাতালে মেয়েকে নিয়ে এসে হতভম্ব হয়ে গিয়েছি। আর এত সকালে যাব কোথায়?’ আমগুড়ির বাসিন্দা কমল রায় বলেন, ‘ছেলের ধুম জ্বর। বসে থাকতে পারছে না। পঁয়তাল্লিশ মিনিট দাঁড়িয়ে থেকে ইমার্জেন্সিতে ডাক্তার দেখানোর সুযোগ হল। কর্তৃপক্ষের কোনও খোঁজখবর নেই। এভাবেই চলছে। সাধারণ মানুষ চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন।’
পুরসভার ৬ এবং ৮ নম্বর ওয়ার্ডে ময়নাগুড়ি গ্রামীণ হাসপাতাল। ৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলার বরুণ ঘোষ এবং ৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলার প্রদ্যোৎ বিশ্বাস জানান, হাসপাতালে মাঝেমধ্যেই এই ধরনের ঘটনা ঘটছে। দু’মাস আগেও এই ধরনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে তুমুল উত্তেজনা ছড়ায়। তাঁরা গিয়ে রোগীর পরিজনদের সঙ্গে কথাবার্তা বলায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়।
এককথায় চরম চিকিৎসক সংকটে ভুগছে এই হাসপাতাল। ময়নাগুড়ি পুরসভার ভাইস চেয়ারম্যান মনোজ রায় বলেন, ‘চিকিৎসকের সংখ্যা কম। সেই কারণেই মাঝেমধ্যেই এই ধরনের সমস্যা হচ্ছে। একজন ডাক্তারকেই ইমার্জেন্সি, ইন্ডোরে রাউন্ড এবং লেবার ওয়ার্ডের দিকে নজর রাখতে হচ্ছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে এই সমস্যার কথা জানানো হয়েছে।’