কৌশিক দাস, ক্রান্তি: সপ্তম শ্রেণির রিমিকার কয়েকদিন ধরেই মন খারাপ ছিল। ওর সবচেয়ে কাছের বন্ধুকে বলেছিল, উঁচু ক্লাসের এক দিদি নাকি ওকে ‘কালো’ বলে বারবার উত্ত্যক্ত করছে। দিনকয়েক আগে বাড়িতেও নাকি সে জানিয়েছিল, স্কুলে যেতে ইচ্ছা করছে না। স্কুলে এক দিদি খুব বিরক্ত করছে।
বাড়ির লোক খুব একটা গা করেননি। ভেবেছিলেন, কয়েকদিন পরে সময় পেলে স্কুল যাবেন প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলতে। সেই সুযোগ আর হল না। বুধবার সকালে বাবা-মা কাজে বেরিয়ে যাওয়ার পর ঘরে রিমিকাকে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখতে পেলেন তার ঠাকুমা। পরিবারের ধারণা, ‘কালো’ বলে বারবার কটাক্ষ করাতেই মেয়ে নিজেকে শেষ করে দিয়েছে।
ক্রান্তি (Kranti) ব্লকের রাজাডাঙ্গার আনন্দপুর চা বাগানের রিমিকা মুন্ডা রাজাডাঙ্গা পেন্দা মহম্মদ উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিল। পরিবার ও প্রতিবেশীরা সকলেই জানান, খুব শান্ত স্বভাবের রিমিকা নিয়মিত স্কুলে যেত। কারও সঙ্গে কখনও বিরোধে জড়ানো ওর স্বভাবে ছিল না।
রিমিকার বাবা সুজিত দেবীপুর চা বাগানের কর্মী। মেয়ের মৃত্যুতে তিনি কিছুটা দিশেহারা। বললেন, ‘এক সপ্তাহ ধরে স্কুলের উঁচু ক্লাসের একটি মেয়ে নাকি ওর গায়ের রং নিয়ে কটূক্তি করত। বাড়িতে কয়েকবার এ নিয়ে বলেওছিল মেয়ে। স্কুলেও যেতে চাইছিল না। কাজের চাপে বিষয়টি নিয়ে খুব একটা গুরুত্ব দিইনি। ভেবেছিলাম, দু’-একদিনের মধ্যে স্কুলে গিয়ে প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলব। কিন্তু মেয়ে সেই সময়টুকুও দিল না।’
রিমিকার দাদা নাগরাকাটার (Nagrakata) একলব্য স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র। ছোট বোনের এমন মর্মান্তিক পরিণতিতে সে হস্টেল থেকে বাড়ি চলে এসেছে। মা সোমারি মুন্ডা কথা হারিয়ে ফেলেছেন ছোট মেয়েকে হারিয়ে। এদিন সকালে পরিবারের লোকজন রিমিকাকে মালবাজার সুপারস্পেশালিটি হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। মৃতদেহ ময়নাতদন্তের জন্য জলপাইগুড়ি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে পাঠানো হয়।
প্রতিবেশী প্রেমলাল ওরাওঁ বলেন, ‘আমাদের মেয়ের এই ঘটনা কিছুতেই মানতে পারছি না। আগামীতে এই ধরনের ঘটনায় কোনও মায়ের কোল যাতে খালি না হয় সে ব্যাপারে স্কুল কর্তৃপক্ষ নজর দিক।’ সুজিত জানিয়েছেন, বৃহস্পতিবার ক্রান্তি পুলিশ ফাঁড়ির পাশাপাশি স্কুলেও মেয়ের মৃত্যুর তদন্ত চেয়ে লিখিত অভিযোগ করা হবে।
রাজাডাঙ্গা পেন্দা মহম্মদ উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক সফিউল আলম বলেন, ‘অভিভাবকরা যদি আমাদের কাছে একবার বিষয়টি জানাতেন তাহলে হয়তো রিমিকাকে এভাবে চলে যেতে হত না।’ রাজাডাঙ্গা পেন্দা মহম্মদ উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ক্লাস টিচার বলেন, ‘ক্লাসে কেউ তো আমাকে এই বিষয়ে জানায়নি। এত পড়ুয়ার ভিড়ে কিছু বুঝতেও পারিনি।’
আনন্দপুর চা বাগানজুড়ে এখন শুধু রিমিকার কথা। বাগান থেকে আরও কয়েকজন সহপাঠী রিমিকার সঙ্গেই স্কুলে যেত। তাদেরই একজন বলে, ‘গতকালও একসঙ্গে স্কুলে গিয়েছিলাম। কয়েকদিন ধরে একটু মনমরা ছিল। আমাদের সঙ্গে কথা কম বলছিল। উঁচু ক্লাসের এক দিদি ওকে ব্যঙ্গ করছে, সেটা আমাকে বলেছিল।’ আরেক সহপাঠীর কথায়, ‘ওর মনের মধ্যে কী যে চলছিল সেটা আমরা কেউই বুঝতে পারিনি। ইশ যদি বুঝতে পারতাম!’