তমালিকা দে, শিলিগুড়ি : তিন থেকে চার ইঞ্চি লম্বা, অনেকটা সিগারের মতো দেখতে। পোশাকি নাম ‘কালিম্পং ক্যান্ডি’। একবার স্বাদ পেলে ফের খাওয়ার ইচ্ছে জাগে মনে। একটিতে যেন স্বাদ মিটতেই চায় না। মূলত ঘন দুধ ও চিনি দিয়ে তৈরি। চকোলেটটির জনপ্রিয়তা শুধুমাত্র ভারতের গণ্ডিতে আটকে নেই, নেপাল, ভুটান এবং বাংলাদেশেও খ্যাতি ভীষণ রকম।
কালিম্পং ক্যান্ডি-র ইতিহাস প্রায় ৭৫ বছরের পুরোনো। ফাদার আন্দ্রেয়াস বাটি একজন খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারক ছিলেন। ১৯৫০ সালের কথা। তখন আন্দ্রেয়াসের বয়স ৩৫-এর কাছাকাছি। তিব্বতে ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্য ছিল তাঁর। তবে কালিম্পংয়ের কাছেই আটকে দেওয়া হয় তাঁকে। আন্দ্রেয়াস আর ফিরে যাননি নিজের বাড়িতে, সেখানেই বসবাসের সিদ্ধান্ত নেন। ইতিহাস ঘাঁটতে গিয়ে জানা গেল, ইংরেজি শেখানোর পাশাপাশি চাষাবাদ ও পশুপালনে ওই ব্যক্তি দক্ষ ছিলেন। সেই থেকে সুইস ওয়েলফেয়ার ডেয়ারি স্থাপনের সিদ্ধান্ত। মূল উদ্দেশ্য ছিল, আয়ের বেশিরভাগ অংশ স্থানীয় মিশনারি পরিচালিত অনাথ আশ্রমে দান করা।
স্থানীয় তরুণী ইলিয়াস রাইয়ের বাবা কাজ করতেন ডেয়ারিতে। শোনাচ্ছিলেন নিজের ছোটবেলার কথা, ‘বেশ কয়েকবার ডেয়ারিতে গিয়েছিলাম কাজ দেখতে। দুধ জাল দেওয়া হত বড় বড় লোহার কড়াইয়ে। ঘন হতে সময় লাগত দীর্ঘক্ষণ। তারপর হাত দিয়ে রোল করে আকার দেওয়া হত ললিপপের। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় আধুনিক যন্ত্রের ব্যবহার শুরু হয়।’
আন্দ্রেয়াসের ডেয়ারিতে ক্যান্ডি ছাড়াও তৈরি হত চিজ আর দই। স্থানীয়রা কর্মসংস্থানের দিশা খুঁজে পান তাঁর হাত ধরে। তবে, ১৯৯০ সাল নাগাদ আচমকা ছন্দপতন। ভিসা পুনর্নবীকরণ না হওয়ায় ফাদার বাটিকে ফিরে যেতে হয় নিজের দেশে। বন্ধ হয়ে যায় সুইস ওয়েলফেয়ার ডেয়ারির ঝাঁপ। কালিম্পং ক্যান্ডি উৎপাদনের নির্দিষ্ট কোনও বড় প্রতিষ্ঠান এখন আর নেই। আন্দ্রেয়াসের ডেয়ারিতে যাঁরা কাজ করতেন একসময়, তাঁদের কেউ কেউ বাড়িতে তৈরি করতে শুরু করলেন সুস্বাদু চকোলেটটি। আরেকদল খুললেন ছোট ডেয়ারি। এখন সেই পরিবারের সদস্যরা ধারা বহন করে চলেছেন। আরও কিছু মানুষ যুক্ত হয়েছেন ব্যবসার সঙ্গে, যাঁরা বা যাঁদের পরিবার আগে এই দুগ্ধজাতীয় খাবার তৈরির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। পরবর্তীতে শিখেছেন স্বাবলম্বী হওয়ার তাগিদে। তেমন একজন পাপ্পু থাপা। বাবার কাছ থেকে কৌশল শিখেছিলেন। এখন নিজেই ক্যান্ডি বানিয়ে বিদেশে রপ্তানি করেন।
সোশ্যাল মিডিয়ায় নাম জেনে পাহাড় ঘুরতে এসে অনেকেই চকোলেটের খোঁজ করেন আজকাল। দোকানের পাশাপাশি মেলে অনলাইনে। শিলিগুড়িতে সেবক রোডের একটি শপিং মলে প্রতি রবিবার গোর্খা হাট বসে। আসেন পাহাড়ি দোকানিরা। সেখানে পাওয়া যায় এই ক্যান্ডি। কালিম্পংয়ে ছোট প্যাকেটগুলোর দাম ৫০ টাকা আর বড় প্যাকেট বিকোচ্ছে ৭০-এ। এছাড়া একটি করে বিক্রি হয় ৫ টাকায়। কর্মসূত্রে কলকাতায় থাকেন দেশবন্ধুপাড়ার বাসিন্দা বুবুন দে। তাঁর কথায়, ‘ঘন দুধের তৈরি চকোলেটটি খেতে ভালো লাগে ভীষণ। পাহাড়ে এখন খুব কম যাওয়া হয়, তাই ইচ্ছে হলে অনলাইনে অর্ডার করি।’
এর সঙ্গে অনেকের অনেক ধরনের স্মৃতি জড়িয়ে। প্রধাননগরের বাড়ি সোহা চৌধুরীর। বলছিলেন, ‘পরিবারের সঙ্গে পাহাড়ে ঘুরতে গিয়ে প্রথমবার টেস্ট করি। তারপর বেশ কয়েকবার হংকং মার্কেট থেকে কিনেছি। এখন অবশ্য মার্কেটে মেলে না।’ প্রিয়তমাকে প্রেম নিবেদন করতেও ক্যান্ডি বেছে নিচ্ছেন কেউ কেউ, হাসিমুখে জানালেন প্রশান্ত তামাং। কালিম্পংয়ে ক্যাফে রয়েছে প্রশান্তর। ছোটবেলা থেকে ক্যান্ডির বিপুল জনপ্রিয়তা দেখে আসছেন তিনি। বহু পর্যটক তাঁর ক্যাফেতে নাকি আসেন শুধুমাত্র সেটারই খোঁজে।
পাহাড়ের স্থানীয় খাবারকে কীভাবে আরও বেশি জনপ্রিয় করে তোলা যায়, সেদিকে নজর দিচ্ছে খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ও উদ্যানপালন দপ্তর। পর্যটকদের বরণ করে নিতে তাই বিশেষভাবে তৈরি চকোলেটটি রাখা হচ্ছে বহু হোমস্টে-তে। অ্যাসোসিয়েশন ফর কনজারভেশন অ্যান্ড ট্যুরিজমের কনভেনার রাজ বসুর কথায়, ‘কালিম্পংয়ের এই ললিপপ বিখ্যাত। এর মতো পাহাড়ের সমস্ত ঐতিহ্যবাহী খাবার যাতে আরও বেশি করে জনপ্রিয় করে তোলা যায়, সেই চেষ্টা চলছে।’
প্রশাসন কতটা উদ্যোগী? জিটিএ’র জনসংযোগ আধিকারিক এসপি শর্মার বক্তব্য, ‘আমরা চেষ্টা চালাচ্ছি। কালিম্পং ক্যান্ডি নিয়ে আলোচনা হয়েছে।’ প্রশ্ন ওঠে, ৭৫ বছরে পা দেওয়া চকোলেটের জন্য ভাবনা এখনও আলোচনার পর্যায়ে আটকে কেন? যার ইতিহাসের সঙ্গে একটা বড় অংশের স্থানীয় মানুষের স্বনির্ভর হয়ে ওঠার গল্প জড়িয়ে, তার প্রতি এমন অবহেলার কারণ কী?