নাগরাকাটা: শান্তি খোঁজে ওরাও। জঙ্গলের বুক চিরে বয়ে যাওয়া রাস্তা, মানুষের উপস্থিতি বন্যপ্রাণীদের সেই শান্তি কেড়ে নেয়। যদি ওই রাস্তা কয়েক বছর বন্ধ থাকে? দু’দণ্ড স্বস্তির শ্বাস ফেলতে পারে হাতি, ময়ূর, সম্বর, চিতল হরিণরা। সড়কের আশপাশ ওদের প্রিয় বিচরণভূমি হয়ে ওঠে।
জলপাইগুড়ির (Jalpaiguri) নাগরাকাটার (Nagrakata) খুনিয়া মোড় থেকে মূর্তির জঙ্গল হয়ে ধূপঝোরা পর্যন্ত ৭ কিমি রাস্তা প্রায় আড়াই বছর ধরে বন্ধ। ধূপঝোরায় মূর্তি সেতু সংস্কারের কারণে যান চলাচল তো দূরের কথা, হেঁটেও ওই রাস্তা দিয়ে জঙ্গলে প্রবেশ পুরোপুরি নিষিদ্ধ। ব্যারিকেড টপকে কেউ ওই রাস্তায় গেলেও বনকর্মীদের কড়া নজরদারিতে ফিরে আসতে হবে তাকে। ইঞ্জিনের কর্কশ শব্দ, হর্নের আওয়াজ থেকে রেহাই পেয়ে মূর্তির জঙ্গল ফের হয়ে উঠেছে বন্যপ্রাণীদের নিভৃত আশ্রয়। শান্ত বন থেকে ভেসে আসছে ময়ূরের কেকা, ঝিঁঝি পোকা, ডাহুক, বৌ-কথা-কওদের সুরেলা ডাক কিংবা পাহাড়ি ময়নার কলতান।
চালসার রেঞ্জ অফিসার প্রকাশ থাপা বলছেন, ‘এটাও এক ধরনের হারানো জিনিস ফিরে পাওয়ার গল্প। মানুষের বিচরণে ওই জঙ্গল থেকে বন্যপ্রাণীরা দূরে সরে যাচ্ছিল। সেতু সংস্কারের কারণে ওই রাস্তায় যাতায়াত বন্ধ থাকায় বন্যপ্রাণীরা শান্তি খুঁজে পেয়েছে। ফিরে এসেছে মূর্তির জঙ্গলে। আমরা নজর রাখছি।’
ধূপঝোরায় পুরোনো মূর্তি সেতু ভেঙে নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০২২-এর শেষলগ্নে। পূর্ত (সড়ক) দপ্তর জানিয়েছে, সেতুর সুপার স্ট্রাকচার এখন সম্পূর্ণ। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে চলতি বছরের শেষে নির্মাণকাজ শেষ হবে। অর্থাৎ টানা ৩ বছর ধরে আধুনিক সভ্যতার ছোঁয়ামুক্ত থাকবে শাল, চিলৌনির ওই জঙ্গল। বন্যপ্রাণীদের পাশাপাশি ফিরছে সবুজ। গাছে গাছে পাখির বাসা। রাস্তায় বসে থাকতে দেখা যাচ্ছে হরিণ, ময়ূরদের।
মূর্তিতে যাওয়ার ওই রাস্তার দুই প্রান্তেই বন দপ্তর ব্যারিকেড দিয়ে রেখেছে। হাতির এতটাই অবাধ যাতায়াত যে, সেই ব্যরিকেড মাঝেমাধ্যেই ভেঙে পড়ছে। জলঢাকা সড়কসেতু পেরিয়েই মূর্তিতে যাওয়ার আগে ব্যারিকেডের পাশেই চন্দ্রচূড় ওয়াচটাওয়ার। সেখান থেকে কিছুটা এগোলে গরুমারা নর্থ রেঞ্জের ওয়াচটাওয়ার। মূর্তি জঙ্গলের কিছুটা চালসা ও কিছুটা গরুমারার অংশ। এখন ওই জঙ্গলে মানুষের অস্তিত্ব বলতে শুধু প্রহরারত বনকর্মীরা।
কিছুটা দূরেই বন দপ্তরের বন্যপ্রাণ শাখার খুনিয়া রেঞ্জের অফিস। মূর্তি জঙ্গলের পুরোনো রূপ ফিরে আসায় উচ্ছ্বসিত খুনিয়া রেঞ্জ অফিসার সজল দে ও অন্যরা। সজল বলেন, ‘সভ্যতার প্রয়োজনে হয়তো পরিকাঠামো তৈরি হয়। তবে জঙ্গলকে আধুনিক সভ্যতার ছোঁয়া থেকে অল্প নিস্তার দিলে ফের জঙ্গলের পুরোনো রূপ ফিরে পাওয়া যায়, তার প্রমাণ মূর্তির বর্তমান ছবি। পূর্ত (সড়ক) দপ্তরের মালবাজারের সহকারী বাস্তুকার সিদ্ধার্থ মণ্ডল জানিয়েছেন, কাজের সূত্রে ওই রাস্তায় তিনি যাতায়াত করছেন। গাছগুলি একে ওপরকে জড়িয়ে আছে। ময়ূরের দলকে পরম নিশ্চিন্তে বসে থাকতেও দেখেছেন অসংখ্যবার। রাস্তাজুড়ে ছড়িয়ে হাতির মল। বন, বন্যপ্রাণী ও ঝরাপাতায় সুন্দর মূর্তি জঙ্গল।
পরিবেশপ্রেমী সংগঠন ন্যাফ-এর মুখপাত্র অনিমেষ বসু বলেন, ‘প্রকৃতিকে বিশ্রাম দিলে সে আমাদের শান্তি দেবে। সেই কথার প্রমাণ করোনার সময়েই পাওয়া গিয়েছে।’