হরিশ্চন্দ্রপুর: বিনোদন, বিনোদন এবং বিনোদন… রিলের নেশায় মত্ত হয়ে প্রাণ হারালেন দুজন। মালদার হরিশ্চন্দ্রপুরের ভবানীপুরের ঘটনা।
সমাজমাধ্যমের অ্যালগরিদম বলে, রিলস বা ভিডিও স্বাদে যত ভিন্ন হবে, তত বেশি দর্শকদের নজর টানবে। তাই ঝুঁকি নাও, শালীনতার মাত্রা ছাড়াও ইত্যাদি ইত্যাদি। আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হওয়ার আগেই সমাজমাধ্যমে ব্যাপক জনপ্রিয় হয় জলপাইগুড়ি জেলার ওদলাবাড়ির লুপ পুল। সতর্কতাকে লাটে তুলে স্টান্টবাজি, রিলস তৈরির ধুম পড়ে যায় সেখানে। ঠিক যেমন হচ্ছে বাংলা-বিহার সংযোগকারী ৩১ নম্বর জাতীয় সড়কের ওপর ভবানীপুরে। সম্প্রতি দেড় কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের একটি ডাবল লেন ফ্লাইওভার যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়। তারপর থেকে শুরু হয়েছে রিলস তৈরি, বাইক নিয়ে কারসাজি। এর আগে ছোটখাটো দুর্ঘটনা ঘটেছে। স্থানীয়রা ফ্লাইওভারে আলো লাগানো ও পুলিশ মোতায়েনের দাবি জানিয়েছেন। কোনও পক্ষের টনক অবশ্য নড়েনি। এবার খেসারত দিতে হল দুই তরতাজা প্রাণকে।
দুর্ঘটনাটি ঘটেছে শনিবার। সন্ধ্যাবেলা ফ্লাইওভারের ওঠার মুখে মুখোমুখি দুই বাইকের সংঘর্ষে গুরুতর আহত হন এক তরুণ ও তিন স্কুল পড়ুয়া। প্রত্যেককে ভর্তি করা হয় মালদা জেলা হাসপাতালে। এদিন সকালে মৃত্যু হয় এক বাইকের চালক পবিত্র দাসের (২৪)। তাঁর বাড়ি পিপলায়। আক্তার ওয়াজ ওরফে তনুজ (১৫) নামে অপর বাইক আরোহীর শনিবার গভীর রাতেই মৃত্যু হয়েছে। আক্তার অঙ্গারমণির বাসিন্দা। সে স্থানীয় একটি স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র ছিল। আক্তারের সঙ্গী মহম্মদ রাজকে কলকাতায় রেফার করা হয়েছে। তাদের সঙ্গে বাইকে থাকা তৃতীয়জন এখনও মালদা হাসপাতালে চিকিত্সাধীন। তিনজনই নাবালক। অর্থাৎ ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া এক বাইকে তিনজন চেপে বেরিয়েছিল ওরা। প্রশ্ন ওঠে, তবে কি নজরদারির ফাঁক গলে এমন অনেকেই দু’চাকা নিয়ে স্টান্ট করছে?
ঘটনার পর এলাকাবাসী বিক্ষোভ শুরু করেন। পথ অবরোধ করা হয়। অভিযোগ, পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে লাঠিচার্জ করে। যদিও এমন কোনও ঘটনা ঘটেনি বলে পালটা দাবি পুলিশ-প্রশাসনের। বিক্ষোভকারীদের দাবি, নবনির্মিত ফ্লাইওভারে বিপজ্জনক কার্যকলাপ চললেও পুলিশের হেলদোল নেই। আলো না থাকায় সূর্য ডুবতেই অন্ধকারে ঢাকে চারপাশ। সেই অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে নেশার আসর বসে। আলো লাগানোর পাশাপাশি ট্রাফিক পয়েন্ট এবং স্পিডব্রেকার বসানোর দাবি ফের জোরদার হচ্ছে।
মৃত পবিত্রর দাদা রামদেব দাস ভারী গলায় বললেন, ‘ভাই পিয়ানো বাদক হিসেবে সুনাম কুড়িয়েছিল। শনিবার বাবাকে আনতে তুলসীহাটা যাচ্ছিল ও। ফ্লাইওভারে ওঠার মুখে উলটো দিক থেকে আসা একটি বাইক ধাক্কা মারে ভাইয়ের বাইকে। অন্য বাইকে চেপে তিনজন কমবয়সি ছেলে ভিডিও তুলতে তুলতে আসছিল দ্রুতগতিতে। পুলিশ সজাগ হলে ভাইকে হারাতে হত না হয়তো।’
স্থানীয় জমি এবং জীবন জীবিকা রক্ষা কমিটির সম্পাদক মোশারফ হোসেনের গলায় ক্ষোভের সুর, ‘ফ্লাইওভারের দুই মুখে কোনও নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই। ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ নেই। বহুবার পুলিশকে অনুরোধ করেছি। লাভ হয়নি। উলটে আমাদের বিক্ষোভে লাঠিচার্জ করল। আমরা চাই, ডিভাইডার বসানো হোক। ২৪ ঘণ্টা পুলিশ মোতায়েন করা হোক।’ সরব শাসকদলের নেতাও। তৃণমূল যুব কংগ্রেসের ব্লক সাধারণ সম্পাদক তথা হরিশচন্দ্রপুর ১ নম্বর পঞ্চায়েত সমিতির বিরোধী দলনেতা স্বপন আলির কথায়, ‘বাসিন্দাদের বিক্ষোভে সহানুভূতি দেখানো তো দূর, লাঠিচার্জ করা হল। অবিলম্বে সমস্যার সমাধান না হলে আমরা বৃহত্তর আন্দোলনে নামব।’
লাঠিচার্জের অভিযোগ অস্বীকার করে হরিশ্চন্দ্রপুর থানার আইসি মনোজিৎ সরকার জানান, বাসিন্দাদের সমস্ত দাবি মেনে কাজ হবে। ২৪ ঘণ্টার জন্য সিভিক ভলান্টিয়ার মোতায়েন করা হবে। জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষের মালদা ডিভিশনের তরফে আলো লাগানোর আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।