Electoral bonds | নির্বাচনি বন্ড: কালো টাকা সাদা করার রাস্তা?

Electoral bonds | নির্বাচনি বন্ড: কালো টাকা সাদা করার রাস্তা?

শিক্ষা
Spread the love


উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: ভারতের রাজনৈতিক অর্থায়নে স্বচ্ছতা নিয়ে বহু বছর ধরেই প্রশ্ন উঠেছে। নির্বাচনি বন্ডের (Electoral bonds) ধারণাটি এই স্বচ্ছতা আনার উদ্দেশ্যেই আনা হয়েছিল বলে সরকার দাবি করেছিল। কিন্তু বাস্তবে এটি উলটো সমালোচনার মুখে পড়ে। সুপ্রিম কোর্টের (Supreme Court docket) নির্দেশে সম্প্রতি এই বন্ডের মাধ্যমে লেনদেন হওয়া অর্থের বিস্তারিত তথ্য প্রকাশিত হওয়ার পর বিষয়টি আরও গুরুতর হয়ে উঠেছে।

রাজনৈতিক দলগুলোর প্রাপ্ত অনুদান: সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের পর স্টেট ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া (SBI) যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা গিয়েছে, ২০১৮ সাল থেকে ২০২৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত মোট প্রায় ১৬,৫১৮ কোটি টাকার নির্বাচনি বন্ড বিক্রি হয়েছে। এই অর্থের সিংহভাগ পেয়েছে ক্ষমতাসীন দলগুলি। কিছু প্রধান দলের প্রাপ্ত অনুদানের একটি তালিকা নীচে দেওয়া হলো:

ভারতীয় জনতা পার্টি (BJP): এই বন্ডের সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী ছিল বিজেপি। প্রায় অর্ধেক বা তারও বেশি অনুদান, অর্থাৎ ৫,৫৯৪ কোটি টাকারও বেশি, বিজেপির তহবিলে জমা পড়েছে। (কিছু রিপোর্টে এই অঙ্ক প্রায় ৬,০৬০ কোটি টাকা পর্যন্ত বলা হয়েছে)।

সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেস (AITC): দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অনুদান সংগ্রহ করেছে তৃণমূল কংগ্রেস। প্রায় ১,৫৯২ কোটি টাকা।

ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস (INC): কংগ্রেস প্রায় ১,৩৫১ কোটি টাকা পেয়েছে।

ভারত রাষ্ট্র সমিতি (BRS): এই দলটি প্রায় ১,১৯১ কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে।

বিজু জনতা দল (BJD): এই দলটির প্রাপ্ত অনুদানের পরিমাণ প্রায় ৭৭৫ কোটি টাকা।

দ্রাবিড় মুনেত্র কাজগম (DMK): DMK প্রায় ৬৩২ কোটি টাকা পেয়েছে।

YSR কংগ্রেস পার্টি: এই দলটি পেয়েছে প্রায় ৩২৮ কোটি টাকা।

অন্যান্য অনেক ছোট দলও এই বন্ডের মাধ্যমে অনুদান পেয়েছে, তবে তাদের প্রাপ্তির পরিমাণ তুলনামূলকভাবে কম।

তবে, এই পুরো প্রক্রিয়ার মধ্যে একটি ব্যতিক্রমী অবস্থান নিয়েছে বামপন্থী দলগুলি। বিশেষত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) বা CPI(M)। তারা প্রথম থেকেই নির্বাচনি বন্ডের তীব্র বিরোধিতা করে এসেছে এবং এই বন্ডের মাধ্যমে কোনো অনুদান গ্রহণ করেনি। তাদের যুক্তি ছিল, যে এই বন্ডগুলি রাজনৈতিক অর্থায়নে স্বচ্ছতা আনার পরিবর্তে কালো টাকা সাদা করার এবং কর্পোরেটদের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলির গোপন বোঝাপড়ার একটি পথ তৈরি করেছে। CPI(M) সহ বাম দলগুলি সবসময়ই রাজনৈতিক তহবিলের সম্পূর্ণ স্বচ্ছতা এবং অনুদানের উৎস প্রকাশের পক্ষে সওয়াল করেছে।

বিতর্কিত দাতা কারা ছিলেন এবং কেন? প্রকাশিত তথ্যে দেখা গিয়েছে, অনেক কোম্পানি, যাদের বিরুদ্ধে সরকারি তদন্ত চলছে বা যারা বিভিন্ন সরকারি চুক্তি পেয়েছে, তারাও নির্বাচনি বন্ডের মাধ্যমে মোটা অঙ্কের অনুদান দিয়েছে। এটি ‘কুইড প্রো কো’ (quid professional quo) অর্থাৎ ‘কিছু পাওয়ার বিনিময়ে কিছু দেওয়া’ – এমন অভিযোগের জন্ম দিয়েছে। কিছু উল্লেখযোগ্য ও বিতর্কিত দাতার উদাহরণ:

ফিউচার গেমিং অ্যান্ড হোটেল সার্ভিসেস (Future Gaming and Resort Providers): লটারি ব্যবসায়ী স্যান্টিয়াগো মার্টিনের এই সংস্থাটি ছিল নির্বাচনি বন্ডের সবচেয়ে বড় ক্রেতা। এই সংস্থাটি প্রায় ১,৩৬৮ কোটি টাকার বন্ড কিনেছিল, যার মধ্যে একটি বড় অংশ DMK-কে দেওয়া হয়েছিল। এই সংস্থাটির বিরুদ্ধে অর্থ পাচার সহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে।

মেঘা ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড (Megha Engineering and Infrastructure Ltd – MEIL): এটি দ্বিতীয় বৃহত্তম দাতা ছিল, যারা প্রায় ৯৬৬ কোটি টাকার বন্ড কিনেছিল। এই সংস্থাটিও বিভিন্ন সরকারি পরিকাঠামো প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত।

অরবিন্দ ফার্মা (Aurobindo Pharma): এই সংস্থাটি বিতর্কিতভাবে অনুদান দিয়েছে। একটি ঘটনায় দেখা গিয়েছে, যখন সংস্থাটির একজন পরিচালককে একটি মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়, তার কিছুদিনের মধ্যেই সংস্থাটি নির্বাচনি বন্ড কিনে ক্ষমতাসীন দলকে অনুদান দেয়। পরবর্তীতে ওই পরিচালক ‘অ্যাপ্রুভার’ (রাজসাক্ষী) হন। এটি ‘ব্ল্যাকমেইল Donation’ বা ‘জবরদস্তি অনুদান’-এর অভিযোগকে আরও উসকে দিয়েছে।

অন্যান্য কর্পোরেট সংস্থা: আরও অনেক কর্পোরেট সংস্থা, যাদের বিরুদ্ধে ED, CBI বা আয়কর বিভাগের তদন্ত চলছিল, তারা নির্বাচনি বন্ডের মাধ্যমে অনুদান দিয়েছে। এরপর অনেক ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে তদন্তের গতি কমে গিয়েছে বা তারা সরকারি চুক্তি পেয়েছে। এটি এক ধরনের আইনি জবরদস্তি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

কিছু ক্ষেত্রে, কোম্পানি তাদের বার্ষিক লাভের ১০০ গুণ পর্যন্ত অনুদান দিয়েছে, যা তাদের আর্থিক স্থিতিশীলতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে এবং কালো টাকা সাদা করার অভিযোগকে আরও জোরালো করে।

রাজনৈতিক দলগুলো কেন নীরব? নির্বাচনি বন্ড বিতর্কে বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলের নীরবতা বেশ লক্ষণীয় এবং উদ্বেগজনক। এর পেছনে কয়েকটি কারণ থাকতে পারে:

সব দলের জড়িত থাকা: যদিও বিজেপি এই বন্ডের সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী ছিল, কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেস, কংগ্রেস, BRS, BJD, DMK সহ প্রায় সব বড় রাজনৈতিক দলই এই বন্ডের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ পেয়েছে। বামপন্থী দলগুলি ছাড়া, অন্য কোনও প্রধান দলই এই ব্যবস্থা থেকে নিজেদের সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন রাখেনি।

বেনামী অনুদানের সুবিধা: দাতাদের পরিচয় গোপন রাখার সুযোগ সব দলের জন্যই সুবিধাজনক ছিল। এর মাধ্যমে তারা কর্পোরেট বা ব্যক্তিগত স্তরে প্রাপ্ত অনুদানের উৎস প্রকাশ না করেই তহবিল সংগ্রহ করতে পারছিল। স্বচ্ছতা কমিয়ে তহবিল সংগ্রহ করা সব দলেরই একটি সাধারণ প্রবণতা।

‘কুইড প্রো কো’র আশঙ্কা: যদি দলগুলো দাতা এবং প্রাপ্ত অনুদানের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে মুখ খোলে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ‘কুইড প্রো কো’ অর্থাৎ সুবিধার বিনিময়ে অর্থ নেওয়ার অভিযোগ আরও জোরালো হতে পারে। এই ভয়ে তারা নীরব থাকতে পছন্দ করছে।

বিরোধী দলের কৌশলগত নীরবতা: কিছু বিরোধী দল হয়তো মনে করছে যে এই বিষয়টি নিয়ে বেশি উচ্চবাচ্য করলে, ক্ষমতাসীন দল তাদের প্রাপ্ত অনুদানের বিষয়ে পাল্টা প্রশ্ন তুলবে, যা তাদের জন্যও অস্বস্তিকর হবে।

ভবিষ্যতের তহবিল সংগ্রহের পথ: যদিও সুপ্রিম কোর্ট নির্বাচনি বন্ড বাতিল করেছে, কিন্তু ভবিষ্যতে রাজনৈতিক দলগুলো কীভাবে তহবিল সংগ্রহ করবে, তা নিয়ে একটি অনিশ্চয়তা রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে, তারা হয়তো বর্তমান বিতর্ক নিয়ে বেশি কথা বলতে চাইছে না, যাতে ভবিষ্যতে অন্য কোনো বেনামী তহবিল ব্যবস্থার সুযোগ তৈরি হলে সেটি গ্রহণ করতে পারে।

আইনি জটিলতা: বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন ছিল এবং রায় প্রকাশের পর অনেক দলই ‘আদালতের রায়কে সম্মান’ করার কথা বলে দায়িত্ব এড়িয়ে গিয়েছে, কিন্তু এই ব্যবস্থার পেছনের অনিয়ম নিয়ে সরাসরি কথা বলেনি।

নির্বাচনি বন্ডের মাধ্যমে লেনদেন হওয়া অর্থের বিস্তারিত তথ্য ভারতের রাজনৈতিক অর্থায়নের অন্ধকার দিকটি উন্মোচন করেছে। এটি কেবল কালো টাকা সাদা করার পথই ছিল না, বরং কর্পোরেট এবং রাজনৈতিক স্বার্থের এক গভীর যোগসাজশের ইঙ্গিত দিয়েছে। বামপন্থী দলগুলি, বিশেষত CPI(M) ব্যতীত, বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলের এই বিষয়ে নীরবতা গণতন্ত্রের জন্য একটি অশনি সংকেত, কারণ এটি সাধারণ মানুষের তথ্য জানার অধিকার এবং রাজনৈতিক স্বচ্ছতার পরিপন্থী। এই ঘটনার পর রাজনৈতিক অর্থায়নে আরও কঠোর ও স্বচ্ছ নিয়ম প্রবর্তনের দাবি আরও জোরালো হয়েছে, যাতে ভবিষ্যতে এমন বিতর্কিত ব্যবস্থার পুনরাবৃত্তি না হয়।



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *