Durga Puja 2025 | পদধূলি পড়ত ব্রিটিশদের! বনেদিয়ানার মেজাজে ঐতিহ্য বহন করে চলেছে সাড়ে তিনশো বছরের বসুমল্লিক বাড়ির পুজো

Durga Puja 2025 | পদধূলি পড়ত ব্রিটিশদের! বনেদিয়ানার মেজাজে ঐতিহ্য বহন করে চলেছে সাড়ে তিনশো বছরের বসুমল্লিক বাড়ির পুজো

ব্যবসা-বাণিজ্যের /BUSINESS
Spread the love


উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্কঃ একশো-দু’শো বছর নয়, প্রায় সাড়ে তিনশো বছর পেরিয়েছে হুগলির মথুরাবাটির বসুমল্লিক বাড়ির পুজো। পুজোর সূচনা করেছিলেন বর্ধমান মহারাজা জগৎ রায়ের দেওয়ান মথুরামোহন বসুমল্লিক। প্রাচীন রীতি মেনে আজও হয়ে আসছে গ্রামের এই পুজো। মথুরাবাটির পার্শ্ববর্তী বোরহল গ্রামেও দুর্গাপুজোর সূচনা করেন মথুরামোহন বসুমল্লিকের ছেলে রামকৃষ্ণ বসুমল্লিক। বর্তমানে বসুমল্লিক পরিবারের শরিকরা এই দুটি পুজোর আয়োজন করে আসছেন শত শত বছর ধরে। দেশভাগের পরেও একই ভাবে এই পুজোগুলি জৌলুস হারায়নি। আচার–নিয়ম মেনেই আজও বাড়ি লাগোয়া ঠাকুর দালানে উমা স্বপরিবারে পূজিত হন। এই পুজোকে ঘিরে আজও একইভাবে রয়েছে গ্রামবাসীদের উন্মাদনা।

চারিদিকে শিউলি ও কাশ ফুলের গন্ধ জানান দিচ্ছে মা আসছেন। ঘরের মেয়ে উমা ফিরছেন ঘরে। কোথাও মণ্ডপের কাজ মাঝপথে, তো কোথাও আবার সবে শুরু হয়েছে। তবে থিমের পুজোর ভিড়ে বনেদিবাড়ির সাবেকি পুজোগুলি ভুলে গেলে চলবে না। তেমনি এক ঐতিহ্যমণ্ডিত বনেদি বাড়ি হল বসুমল্লিক বাড়ি। সাবেকি পুজোর প্রসঙ্গ উঠলে সবার প্রথমে মনে পড়ে হুগলি জেলার জাঙ্গিপাড়া থানা এলাকার মথুরাবাটি ও  বোরহল গ্রামের বসুমল্লিক বাড়ির পুজো। ইতিহাস বিজড়িত এই বর্ধিষ্ণু বাড়ির পুজোতেও থাকে বনেদিয়ানার মেজাজ। এবাড়ির পুজোর ইতিহাস বসুমল্লিকদের গৌরবজ্জ্বল অতীতকে আষ্টেপৃষ্টে ধরে রেখেছে। বসুমল্লিক বাড়ির পুজো ও ইতিহাস নিয়ে রয়েছে কিছু তথ্য।

জানা যায়, আজ থেকে প্রায় সাড়ে তিনশো বছর আগে বর্তমান হুগলি জেলার জাঙ্গিপাড়া থানার অন্তর্গত মথুরাবাটি গ্রামে দুর্গাপুজোর সূচনা করেছিলেন তৎকালীন বর্ধমান রাজা জগৎ রায়ের দেওয়ান মথুরামোহন বসুমল্লিক। প্রায় একই সময়ে পার্শ্ববর্তী বোরহল গ্রামে পুজোর সূচনা করেছিলেন রামকৃষ্ণ বসুমল্লিক। মথুরামোহনবাবুকে উপঢৌকন হিসেবে একপ্রকার জনবসতি শূন্য গ্রামে ১৫০০ বিঘা জমি দান করেছিলেন বর্ধমান রাজা। তাঁর হাত ধরেই ধীরে ধীরে বসতি গড়ে ওঠে সেই গ্রামে। গ্রামের নাম হয় মথুরাবাটি। সেইসময় গ্রামবাসীদের নিয়ে নিজেদের ঠাকুরদালানে সূচনা হয় দুর্গাপুজোর। বসুমল্লিক পরিবারের পুজো হলেও পুজোর যাবতীয় কাজকর্মের দায়িত্ব রয়েছে গ্রামবাসীদের উপর। যাঁরা পুজোর কাজ করেন, তাদের ‘টহুলি’ বলা হয়। এমন টহুলির সংখ্যা ১৫। এরাও বংশপরম্পরায় এই পুজোর কাজ করে আসছেন। প্রতিমা তৈরি থেকে শুরু করে মালাকার, বাদ্যকার, সুতকার সহ সবাই এই গ্রামেরই বাসিন্দা। ঠাকুরদালানেই তৈরি হয় একচালা ডাকের সাজের প্রতিমা। সাড়ে তিনশো বছরের পুরোনো কাঠামোতেই মাটির প্রলেপ লাগিয়ে মূর্তি তৈরি করেন গ্রামেরই পালেরা। আজ পর্যন্ত কাঠামোর পরিবর্তন হয়নি। তবে এই বংশের কুলদেবতা হলেন উত্তর বাহিনী ঠাকুর।

এই পরিবারের সদস্য সোমনাথ রাহা বলেন, ‘এখনও হুগলি জেলার বোরহল গ্রাম সহ কলকাতা লাগোয়া জেলাগুলিতে আমাদের বংশের অনেকে রয়েছেন। অনেকে পেশার কারণে বিদেশেও থাকেন। পুজোর সময় সবাই ফিরে আসেন গ্রামের এই প্রাচীন পুজোতে। আগে মাটির দালান ছিল। এখন সেই মাটির দালান অক্ষত রেখেই পাকা করা হয়েছে। সেখানে প্রতিমা গড়ার কাজ চলেছে।’

পরিবারের অপর এক সদস্য বিশ্বব্রত বসুমল্লিক বলেন, ‘চামুণ্ডা রূপে পুজিত হন দেবী। বসুমল্লিক পরিবারের পুজোয় বিশেষত্ব রয়েছে দেবীর ভোগে। অতীতে পুজোয় পাঁঠা বলি দেওয়া হত। এখন আর পাঠাবলি হয় না। বদলে কুমড়ো, আখ, লেবু বলি দেওয়া হয়। ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত চলে চণ্ডীমঙ্গল গান। ভোগে থাকে জমির ধানের চালের অন্ন, মুড়কি, নাড়ু, মিষ্টি, ফল। সপ্তমী, অষ্টমী, নবমীতে দেওয়া হয় ৩০ কেজি চালের নৈবেদ্য। আর সন্ধিপুজোয় ঠাকুরকে দেওয়া হয় ৬০ কেজি চালের নৈবেদ্য। এছাড়া নবমীতে মাছ ও দশমীতে মাংস নিবেদনেরও নিয়ম রয়েছে। প্রতিদিন সন্ধ্যায় গানের আসর বসে ঠাকুরদালানে। চার দিনের পুজো কোথা দিয়ে যেন হুশ করে কেটে যায়। ব্যস্ততার কারণে সেটা বুঝতেও পারি না।”

বসুমল্লিক পরিবারের বর্তমান বংশধর অমিত বসুমল্লিক বলেন, “আমাদের এই পুজোর বয়স প্রায় সাড়ে তিনশো। এত বছর ধরে একই কাঠামোতে পুজো হয়ে আসছে। বংশের পুকুরে প্রতিমা নিরঞ্জন হয়। গ্রামের জেলেদের কাঁধে চাপিয়ে প্রতিমার বিসর্জন হয়। প্রতিমা থেকে মাটি গলতে শুরু করলে সেই কাঠামো তুলে নিয়ে আসা হয়। তার উপরে মাটির প্রলেপ লাগিয়ে তৈরি হয় নতুন প্রতিমা। আজ পর্যন্ত কাঠামোর পরিবর্তন হয়নি।”

তিনি আরও বলেন, “শুনেছি, ইংরেজ আমলে ঘোড়ার গাড়িতে চেপে পুজোতে আসতেন ব্রিটিশরাও। পুজোতে উপহার, ফল, রকমারি মিষ্টি পাঠাতেন বর্ধমানের রাজা।”

পরিবারের অপর এক সদস্য পেশায় রেলকর্মী পার্থ বসুমল্লিক বলেন, ‘ভক্তি নিষ্ঠার জন্যই প্রতি বছর পুজোতে ছুটে আসি এখানে। জমিদারি চলে গেলেও নিয়ম নিষ্ঠায় কোনও ত্রুটি নেই।’

পুজো মানেই বাড়ির মহিলাদের দম ফেলার ফুরসত থাকে না। এই পরিবারের বউ মৌমিতা বসুমল্লিক বলছিলেন, “এখানেই শুনেছি, এই পুজোর বয়স প্রায় সাড়ে তিনশো বছর। শুনেছি এই পুজোর সঙ্গে বহু ইতিহাস জড়িয়ে রয়েছে। শাশুড়ির কাছে পুজোর অনেক গল্প শুনেছি। এক বার হলেও পুজোর দিনে ছুটে আসি এখানে। সমস্ত ধরনের নিয়ম মেনে দুর্গার আরাধনা চলে। সারা বছর এই চারটে দিনের জন্য আমরা সকলে অপেক্ষা করে থাকি। ব্যস্ততার অন্ত থাকে না, তবে তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে এক অপূর্ব তৃপ্তি।”

প্রায় সাড়ে তিনশো বছর ধরে চলতে থাকা পুজোকে এ ভাবেই এগিয়ে নিয়ে চলেছে মথুরাবাটি ও বোরহল গ্রামের বসুমল্লিক পরিবার। প্রাচীনত্বের বিচারে হুগলি জেলায় এই বাড়ির পুজো তাই বাকিদের থেকে অনেকটাই আলাদা।



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *