অমৃতা চন্দ, দিনহাটা: সীমান্ত মানে বিভেদরেখা। বাদলগির এলাকার সাবেক ছিটমহলবাসীদের সঙ্গে পুজো কাটালে অবশ্য একথা মোটেও মনে হবে না। সেখানে মানুষের কাছে কাঁটাতার এক অদৃশ্য প্রাচীর। দুর্গাপুজোর (Durga Puja 2025) ঢাকে কাঠি পড়লেই তাঁরা অবশ্য সেই প্রাচীরের কথা ভুলে যান। কাঁটাতারের দু’পারের মানুষ এক বৃহৎ পরিবারের মতোই মিলেমিশে এক হয়ে যান। দুর্গাপুজো এখানে কেবল ধর্মীয় কোনও উৎসব নয়, এক অভূতপূর্ব ভ্রাতৃত্বের নিদর্শন।
দুর্গাপুজোর দিনগুলোতে বাদলগির গ্রামের সকালটা অন্যরকম উত্তেজনা নিয়ে শুরু হয়। কখন বাবা-মায়ের হাত ধরে কাঁটাতারের ওপারে পুজো দেখতে যাবে বলে ছোট ছেলেমেয়েরা নতুন জামা পরে অপেক্ষা করে। মনে মনে ঠিক করা থাকে, কোন পুজোয় আগে যেতে হবে, কোনটা পরে। আর একবার অনুমতি মিললেই শুরু হয় সীমান্ত পারাপার। এভাবেই তাদের পুজোর আনন্দ পূর্ণতা পায়।
বাদলগির গ্রামের ৪৪ নম্বর গেট প্রতিদিন সকাল, দুপুর ও বিকেলে এক ঘণ্টার জন্য খোলে। বিকেল ৪টার সময় তাঁরা এপারে এসে রাতভর পুজো দেখেন।
তারপর এপারের কোনও আত্মীয়ের বাড়িতেই থেকে যাওয়া। পরের দিন সকালে গেট খুললে এই বাসিন্দারা নিজেদের বাড়ি ফেরেন। সাবেক ছিটমহলের বাসিন্দা মাহিরুদ্দিন শেখ, আইয়ুব শেখ, হাসিনা বিবিরা বহুদিন ধরে এভাবেই পুজো কাটাচ্ছেন। ‘এখানে মণ্ডপ নেই, ঢাকের আওয়াজ নেই। তাই ছুটি পেলেই আমরা মা দুর্গার আরাধনা দেখতে এপারে ছুটে আসি। অঞ্জলি দিই। এপারে এসে কখনও মনে হয় না আমরা আলাদা কেউ।’ বলতে বলতে চোখে জল চিকচিক করে উঠছিল আইয়ুব শেখের। হাসিনা বিবি বলেন, ‘মাঝে কাঁটাতার থাকলেও দুর্গাপুজো আমাদের মিলিয়ে দেয়। মনে হয় আপনজনদের কাছেই আছি।’ গ্রামের পুজো উদ্যোক্তারাও এই আনন্দেই পুজোর আয়োজন করেন। বাদলগির সর্বজনীন দুর্গাপুজো কমিটির সভাপতি ইন্দ্রজিৎ অধিকারী বললেন, ‘ওপারের মানুষদের জন্য আমরা বিশেষ ব্যবস্থা করি। পুজো মিলনোৎসব। তাঁদের ছাড়া আনন্দ অসম্পূর্ণ।’ বাদলগির আদি মিতালি সংঘের সভাপতি তপনকুমার বর্মন বলেন, ‘এবছর আমাদের পুজোর ৪৬তম বছর। প্রতিবারই দু’পারের মানুষ একত্রিত হয়ে পুজো উপভোগ করেন। এর চেয়ে আনন্দের কিছু নেই।’
সন্ধ্যা হলেই যখন গোটা বাদলগির গ্রাম রোশনাইয়ে সেজে ওঠে, দুই বাংলার মানুষের কোমর দোলে ঢাকের তালে ধুনুচি নাচে, তখন সদা সতর্ক, সদা রূঢ় সীমান্তরক্ষীদের মনও উৎসবের প্রশান্তিতে ভরে ওঠে।