দিনহাটা: শুধু জিলিপি নয়, ভেটাগুড়ির শোলা শিল্প সমগ্র উত্তরবঙ্গের গর্ব। একসময় এই ভেটাগুড়ি শোলার গ্রাম নামে পরিচিত ছিল। এই শোলা শিল্প আজ হারানোর পথে। এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে প্রশাসনের তরফে কোনও উদ্যোগই আজ নেওয়া হচ্ছে না। ফলে নবীন প্রজন্ম এই শিল্পের প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে। অথচ একসময় এই ভেটাগুড়িতে তৈরি শোলার ডাকের সাজে কত দেবদেবীর মূর্তি সেজে উঠেছে। বিয়ে হোক বা অন্নপ্রাশন, ভেটাগুড়ির শিল্পীদের তৈরি শোলার মুকুটের কদর ছিল সব জায়গায়। আজও উত্তরবঙ্গের একাধিক মহকুমা, জেলা এবং অসমের একাংশে ভেটাগুড়ির শিল্পীদের তৈরি শোলার মালা, মুকুটের চাহিদা রয়েছে। তবে আগের মতো সেই উদ্যম আর নেই।
আগে ভেটাগুড়ির অলিগলিতে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত শোলার ফালি কাটার কাজ চলত। এলাকার প্রবীণরা এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। ভেটাগুড়ির বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব শান্তি বর্মনের গলায় শোনা গেল আক্ষেপের সুর। তাঁর পাশে পড়ে রয়েছে অর্ধেক তৈরি শোলার মালা, মুকুট সহ অন্যান্য পুজোর সামগ্রী। তাঁর কথায়, ‘সকাল থেকে এই কাজ করি। কিন্তু এখন আর সেরকম বাজার নেই। এই কাজ করে সংসার চলে না। তাই ছেলেমেয়েরা এই কাজ শিখতে চায় না। সরকার থেকে যদি প্রশিক্ষণ দিত বা ঋণের ব্যবস্থা করত, তাহলে হয়তো নতুন প্রজন্মের উৎসাহ থাকত।’
গ্রামের প্রবীণ শিল্পী লিচু বর্মনের কথায়, ‘একসময় শোলার কাজ নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় প্রদর্শনী করতে গিয়েছি। তখন এর চাহিদা ছিল অন্যরকম। এখন মূলধনের জোগান না থাকায় অনেকে এই শিল্প থেকে সরে আসতে চাইছেন।’ তিনি জানান, একসময় গ্রামের কোনও শিল্পীর বাড়িতে সরকারের তরফে প্রশিক্ষণ দেওয়া হত। এখন সেসবের বালাই নেই। এমনকি ১০–১২ বছর আগে এই শিল্পের জন্য ঋণ পাওয়া যেত। এখন নিজেদের টাকা বিনিয়োগ করে এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে হচ্ছে। ঋণ পেলে সুবিধে হত বলে তাঁর দাবি। এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে ঋণের পাশাপাশি স্থায়ী প্রশিক্ষণকেন্দ্রের প্রয়োজন রয়েছে। তবে, এই শিল্প ফের ঘুরে দাঁড়াতে পারবে বলে মনে করেন তিনি। দিনহাটা-১’এর বিডিও গঙ্গা ছেত্রী বলেন, ‘এই শিল্পীরা তাঁদের সমস্যা নিয়ে কখনও আমার কাছে আসেননি। বর্তমানে একাধিক বিষয়ে প্রশিক্ষণ হয়। তাঁরা চাইলে এবিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।’
অন্যান্য সমস্যার পাশাপাশি শোলাশিল্পীদের অন্যতম সমস্যা হল নির্দিষ্ট বাজার না থাকা। শোলাশিল্পী রত্না বর্মনের কথায়, ‘আমাদের থেকে মিডলম্যানরা শোলার সামগ্রী নিয়ে যান। তাঁরা বাজারে ভালো দাম পেলেও আমাদের হাতে সামান্য টাকা আসে।’ তাঁর মতে, ‘দেওয়ানহাটে পাটির জন্য যেমন নির্দিষ্ট বাজার রয়েছে, তেমনি শোলার সামগ্রীর জন্য নির্দিষ্ট বাজার থাকলে ন্যায্যমূল্য পাওয়া সম্ভব।’ এলাকার প্রবীণদের কথায় এই শিল্প তো কেবল ব্যবসা নয়, এটা তাঁদের সংস্কৃতি। বাজার নেই, প্রশিক্ষণ নেই, ঋণ নেই তাই এই শিল্প দিন-দিন যেন মরে যাচ্ছে।