রণজিৎ ঘোষ, ঘুম : পাহাড়ের গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে একটা সময় বড় ভূমিকা নিয়েছিল সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত দুগ্ধ সমবায় সংস্থা হিমুল। দার্জিলিং, কালিম্পংয়ের বিভিন্ন জায়গায় গোপালনের ব্যবস্থার মাধ্যমে দুধের উৎপাদন করে এবং কৃষকদের নিয়ে সমবায় তৈরি করে সেই দুধ কিনে নেওয়া হত। এই কাজের জন্য পাহাড়ের বিভিন্ন জায়গায় লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে চিলিং প্ল্যান্টও বসানো হয়েছিল। উৎপাদিত দুধ হিমুলকে বিক্রি করে রোজগারের ভালো পথ দেখেছিলেন পাহাড়ের মানুষ। কিন্তু সবকিছুই এখন অতীত। হিমুল দুগ্ধ উৎপাদনকারী সংস্থারই আর কোনও অস্তিত্ব নেই। পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকা পাহাড়েও চিলিং প্ল্যান্টগুলি ধ্বংসের পথে। এই পরিস্থিতিতে হিমুলের সঙ্গে যুক্ত থাকা গোপালকদের অনেকে এখন দিনমজুরি করে সংসার টানছেন।
একদা এই প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত কৃষক সোনম ডুকপার কথায়, ‘গোরু পালন করে সেই দুধ সমবায়ের মাধ্যমে হিমুলকে দিতাম। ভালোই চলছিল সবকিছু। কিন্তু বেশিদিন স্থায়ী হল না। হিমুলই বন্ধ হয়ে গেল। আমাদের গোরু পালনের কারবারও উঠে গিয়েছে। এখন দিনমজুর হিসাবে কাজ করে সংসার চালাই।’
গোর্খাল্যান্ড টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (জিটিএ) মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক শক্তিপ্রসাদ শর্মা বলছিলেন, ‘প্রতিটি চিলিং প্ল্যান্ট ঘুরে দেখেছি। প্রতিটিই ভগ্নপ্রায় অবস্থায় রয়েছে। পাহাড়ের অর্থনীতি চাঙ্গা করতে আবার গোরু পালন এবং দুধ উৎপাদনের মাধ্যমে এখনকার অর্থনীতি পুনরুজ্জীবিত করার পরিকল্পনা রয়েছে। কিন্তু এখন সমবায় সমিতি তৈরির জন্য রেজিস্ট্রেশন দেওয়া বন্ধ থাকায় কিছু করা যাচ্ছে না।’
গ্রামীণ অর্থনীতিকে মজবুত করতেই একটা সময় সরকারি সহায়তায় হিমালয়ান কোঅপারেটিভ মিল্ক প্রোডিউসার্স ইউনিয়ন লিমিটেড (হিমুল) তৈরি হয়েছিল। মাটিগাড়ার খাপরাইলে কারখানা এবং প্রশাসনিক ভবন তৈরি হয়। রাজ্য সরকারের উদ্দেশ্য ছিল, গ্রামের বাড়িতে যে গোরু পালন হয়, সেই গোরুর দুধ কিনে নেওয়া হবে। পাশাপাশি অন্য বাসিন্দাদেরও গোরু পালনে উৎসাহিত করা হবে। এভাবেই খড়িবাড়ি, নকশালবাড়ি, মাটিগাড়ার পাশাপাশি পাহাড়েও গ্রামের মানুষকে উৎসাহিত করা হয়েছিল। যার ফলে সমতলের পাশাপাশি পাহাড়েও হাজার হাজার মানুষ গোপালনে উৎসাহিত হন এবং দুধের জোগান দিতে শুরু করেন। প্রয়োজন বুঝে সরকারি খরচে একে একে ঘুম, সুখিয়াপোখরি, রংলি রংলিয়ট, বিজনবাড়ি, কালিম্পং এবং লাভায় চিলিং প্ল্যান্ট বসানো হয়। তারপর পরীক্ষাগার থেকে শুরু করে কর্মী নিয়োগ, কর্মীদের থাকার ব্যবস্থা সমস্তটাই হয়েছিল। প্রথমদিকে পাহাড়ের গোপালকরা এই চিলিং প্ল্যান্টে এসে দুধ বিক্রি করতেন। সেখানে দুধ ঠান্ডা করে ট্যাংকারে ভরে মাটিগাড়ার কারখানায় পাঠাতেন। সেখানে প্রক্রিয়াকরণের পর প্যাকেটবন্দি হয়ে সেই দুধ বিক্রির জন্য সমতল এবং পাহাড়ের বাজারে যেত। মাটিগাড়া থেকে দার্জিলিংয়ে দুধ পৌঁছাতে সময় অপচয় হওয়ায় পরবর্তীকালে ঘুম, বিজনবাড়ি এবং লাভায় প্যাকেটিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়। সমতলের পাশাপাশি পাহাড়েও একচেটিয়া বাজার ধরেছিল হিমুল। এই প্রকল্পে শুধুমাত্র পাহাড়েই ২০-২২ হাজার গোপালককে নিয়ে হাজারের বেশি সমবায় তৈরি হয়। যার মাধ্যমে দৈনিক গড়ে ২০ হাজার লিটার দুধ পেত হিমুল। কিন্তু সঠিক পরিকল্পনার অভাবে ২০০৯-২০১০ সাল থেকে একে একে চিলিং প্ল্যান্টগুলি বন্ধ হয়ে যায়। পরে হিমুল প্রকল্পটাই রাজ্য সরকার তুলে দেয়।
দার্জিলিংয়ের ঘুমে থাকা চিলিং প্ল্যান্টে গিয়ে দেখা গেল, ভগ্নদশায় একটি ভবন দাঁড়িয়ে রয়েছে। ভিতরে প্রকল্পের সব সরঞ্জামই নষ্ট হয়ে গিয়েছে। কোথায় পরীক্ষাগার, কোথায় দুধ জমা নেওয়া হত, কোথায় কর্মীরা থাকতেন, তা ঘুরিয়ে দেখালেন স্থানীয় বাসিন্দা বন্দনা তামাং, রেশমি ছেত্রীরা। রেশমির কথায়, ‘একটা সময় হিমুল আমাদের নতুন করে বাঁচার আশা জাগিয়েছিল। বাড়িতে গোরু পালন করে দুধ বিক্রি করে ভালোভাবে সংসার চালাতাম। কিন্তু হঠাৎই সবকিছু বন্ধ হয়ে গেল। আমরাও গোরুগুলি জলের দরে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হলাম।’ তবে এখনও বিজনবাড়িতে কয়েকশো পরিবারে গোরু পালন করা হয়। সেই দুধ কিনে নিয়ে যাচ্ছে সিকিম ডেয়ারি।