কোচবিহার: এ যেন এক অন্য ধরনের লক্ষ্মীর ভাণ্ডার। এই ভাণ্ডারের জিনিস সারা জীবনেও শেষ হওয়ার নয়। সে রাজ্য বা কেন্দ্রে যে সরকারই আসুক এই ভাণ্ডারে হাত দেওয়ার অধিকার কারও নেই। প্রায় প্রতিটি বাড়ির আনাচে-কানাচে ব্যবহারের অনুপযুক্ত অথবা ভাঙাচোরা বহু জিনিস পড়ে থাকে। তেমনি প্রতিদিন ঘরে আসা খবরের কাগজও জমে জমে ডাঁই হয়ে যায়। সেগুলো সময়মতো বিক্রি না করলে জায়গার ভীষণ অসুবিধা হয়। আর ঠিক সেই সময় খোঁজ পড়ে ভাঙাড়িওয়ালা বা এককথায় ভাঙাড়িদের। এই সব জিনিস বিক্রি করে দিলে তাতে যেমন ঘর পরিষ্কার থাকে, তেমনি ফাঁকতালে দুটো পয়সাও হাতে আসে।
ঘরের ভাঙাচোরা জিনিস বিক্রি করে সেই টাকা সাধারণত ঘরের মেয়েদের হাতেই যায়। ব্যতিক্রম হয়তো রয়েছে কিন্তু সেটা নিয়ম নয়। আর এটা কিন্তু আজ থেকে নয়, কয়েক যুগ ধরেই হয়ে আসছে। গৃহ সহায়িকা থেকে শুরু করে উচ্চপদে কর্মরতা – এই বিষয়ে সকল মেয়েই সমান। এই টাকা কারও কাছে প্রয়োজনের আবার কারও কাছে বিনোদনের। কারণ যাই থাকুক না কেন, এই টাকাটির উপর অলিখিত দখলদারি কিন্তু মেয়েদের কাছেই থেকে গিয়েছে। আজকাল তো ভাঙাচোরা বিক্রির লোকেদের ফোন নম্বরও সেভ করা থাকে নিজেদের মোবাইলে।
সংসারে যেমন নতুন জিনিস কেনা হয়, তেমনি বহু জিনিস বাতিলও হয়ে যায়। সেগুলো জমে থাকলেই ঘর নোংরা হয়। এছাড়াও প্রতি মাসের খবরে কাগজ তো রয়েইছে। তাই এক-দু’মাস অন্তর অন্তর লোক ডেকে এগুলো সব বিক্রি করে দিই। জানালেন সূর্য সেন রোডের সুষমা রায়। বললেন, এসব ভাঙাচোরা জিনিস বিক্রি করার টাকা মায়ের কাছেই থাকে। সেখান থেকে আবার তার নাতিও ভাগ পায়। মা পেনশন পেলেও এই টাকা পাওয়ার মজাই আলাদা।
দক্ষিণ খাগড়াবাড়ির রূপা ভট্টাচার্য। বাড়িতে নিজের বুটিক রয়েছে। এছাড়াও একটি সরকারি সংস্থায় কনট্রাকচুয়াল চাকরি করেন। বললেন, এই তো সেদিন জলের কল ঠিক করতে এসে নতুন কলের মুখ লাগাতে হল। পুরোনো কলের মুখগুলো সব জমে ছিল। এছাড়াও মাঝেমধ্যেই কিছু না কিছু অদরকারি জিনিস বের হয়, সেগুলো সব না জমিয়ে বিক্রি করে দিই। আর এই জিনিস বিক্রির টাকা ঠিক সংসারের কোনও না কোনও কাজে লেগে যায়।
প্রতি মাসে না হলেও দু’মাস অন্তর অন্তর দেড়-দুশো টাকার ভাঙাচোরা জিনিস বিক্রি করেন বাঁধেরপাড়ের জ্যোৎস্না দাস। তিনটি বাড়িতে গৃহ সহায়িকার কাজ করেন তিনি। এই টাকাটা তার উপরি পাওনা। একগাল হেসে জানালেন, ওই টাকায় আমি পান খাই, আর নাতি চকোলেট। প্রশ্ন শুনেই হেসে উঠলেন কোচবিহারের একমাত্র মহিলা ঠিকাদার মদনমোহন কলোনির কাজরী ভদ্র। বললেন, ‘আমার বাড়িতেও একই গল্প। যেমন যেমন ভাঙাচোরা জিনিস জমে সেভাবেই বিক্রি করে দিই তবে পয়সাটা একটা নির্দিষ্ট জায়গায় জমিয়ে রাখি। বেশ কয়েকবারের টাকা জমিয়ে বাড়ির সকলে মিলে পিকনিক করি। এটা কিছুই না, এক ধরনের আনন্দ।’
ভাঙাচোরা জিনিস বিক্রি করার টাকা জমিয়ে একজন যেমন চাল রাখার স্টিলের ড্রাম কিনেছেন, তেমনি এই টাকায় ঘরের পর্দা কিনে ঘরের আব্রু রক্ষা করতে দেখা গিয়েছে আরেকজনকে। অনেকে রাস্তায় ডেকে যাওয়া ভাঙাড়িওয়ালা তাঁদের জমিয়ে রাখা জিনিস বিক্রি করেন, আবার অনেকে নির্দিষ্ট লোক ছাড়া অন্য কারও কাছে বিক্রি করতে চান না। ভাঙাড়িওয়ালাদের সঙ্গে দাঁড়িপাল্লার ওজনে কারচুপি বা দামাদামি নিয়ে একটা খণ্ডযুদ্ধ করে বিক্রির টাকা হাতে নিয়ে যেন একটা যুদ্ধ জয়ের হাসি ফুটে ওঠে তাদের মুখে।