সিতাই: কেউ ষষ্ঠ শ্রেণির পড়ুয়া তো কেউ আবার নবম শ্রেণির ছাত্রী। কাগজে-কলমে ওরা প্রত্যেকেই নাবালিকা। কিন্তু প্রেমের টানে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ছে প্রত্যেকেই। গত এক মাসে সিতাই থানায় এমন আটটি নিখোঁজের ঘটনা ঘটেছে। নিখোঁজ নাবালিকাদের উদ্ধার করে এমনই তথ্য পাচ্ছে পুলিশ। সিতাই সীমান্তবর্তী ব্লক হওয়ায় বাড়ছে নাবালিকাদের পাচার হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা। এর জেরে পুলিশ প্রশাসনেও উদ্বেগ ছড়িয়েছে।
পুলিশের দেওয়া তথ্যে দেখা যাচ্ছে গত এক সপ্তাহে তিনটি নাবালিকা নিখোঁজের ঘটনা ঘটেছে। গত বুধবার এক ষষ্ঠ শ্রেণির নাবালিকা নিখোঁজের ঘটনায় পুলিশের প্রাথমিক অনুমান ওই ছাত্রী মায়ের বকুনি খেয়েই আত্মীয়ের বাড়িতে চলে গিয়েছিল। পরে তাকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু বাকি ক্ষেত্রে প্রেমের সম্পর্কের ঘটনা উঠে আসায় চিন্তিত অভিভাবকরা।
পুলিশ সূত্রে খবর, প্রতিটি ক্ষেত্রে যে থানায় অভিযোগ দায়ের হচ্ছে তা নয়, সব অভিযোগ থানায় এলে এই পরিসংখ্যান আরও বাড়বে। পুলিশের এক আধিকারিকের বক্তব্য, অনেকক্ষেত্রেই এধরনের ঘটনায়, অভিভাবকরাই পরিবারের সম্মানের কথা ভেবে নিজেরাই তা মিটিয়ে নেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মেয়েরা কেউ অষ্টম আবার কেউ বা নবম বা দশম শ্রেণিতে পড়ছে। আর পড়াশোনা চলাকালীনই কোনও না কোনও বন্ধুর সঙ্গে পালিয়ে যাচ্ছে তারা। আবার সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে বন্ধু পাতিয়ে তার সঙ্গে চলে যাচ্ছে। ভৌগোলিক দিক থেকে সিতাই একটি সীমান্তবর্তী মহকুমা। এখানে কমবয়সি মেয়েদের অনেকক্ষেত্রেই ভালোবাসার ফাঁদে ফেলে পাচারের ঘটনাও ঘটছে। পরপর নাবালিকা নিখোঁজের ঘটনায় যথেষ্ট চিন্তায় পড়েছে পুলিশ।
সিতাই থানার আইসি দীপাঞ্জন দাস বলেন, ‘পুলিশ প্রশাসনের তরফে নিয়মিত সচেতনতা কর্মসূচি নেওয়া হচ্ছে। নাবালিকা বিবাহ থেকে নারী পাচার, গুড টাচ ও ব্যাড টাচের মতো বিষয়গুলি নিয়ে স্কুলগুলিতে সচেতনতা কর্মসূচি গ্রহণ করেছি। তারপরেও এধরনের ঘটনা কমছে না।’
কোচবিহার এমজেএন মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক চিরঞ্জীব রায়ের কথায়, ‘অষ্টম থেকে দশম শ্রেণিতে পড়া মেয়েদের বয়স অনুযায়ী তারা বয়ঃসন্ধিকালের সময়কাল। আর এসময়টাই ছেলেমেয়ে উভয়ের শরীর ও মন চঞ্চল থাকে। এবং উভয়ের শারীরিক দিক থেকে আমূল পরিবর্তন দেখা যায়। এরফলে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ বাড়তে থাকে। এসময় তাদের বন্ধুর গ্রুপ হয় প্রিয়জন। আর এই অস্তিত্বের সংকটে ভুগতে থাকা ছেলেমেয়েরা তখন একে অপরকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে গিয়ে পালানোর রাস্তাকে বেছে নেয়।’ আইনজীবীরা একাধিক স্কুলে ইতিমধ্যে সচেতনতামূলক কর্মসূচি নিয়েছেন বলে দাবি করেছেন। আইনজীবী কল্লোল রায় সিংহ বলেন, ‘অল্পবয়সি ছেলেমেয়েদের পালানোর প্রবণতা অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে। আর এক্ষেত্রে সোশ্যাল মিডিয়া বড় ভূমিকা পালন করছে। তাই এক্ষেত্রে প্রশাসনিক স্তরে সচেতনতা আরও বেশি প্রয়োজন।’
শিক্ষক ভগীরথ বর্মনের কথায়, ‘এধরনের ঘটনা যথেষ্ট উদ্বিগ্নের। বিশেষ করে অল্পবয়সি মেয়েদের অল্প সময়ে বিখ্যাত হওয়ার তাগিদ এই সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। তারা বুঝতেই চাইছে না কোনটি তাদের জন্য ভালো আর কোনটি ভালো নয়। সেক্ষেত্রে তারা অভিভাবক, স্কুল শিক্ষক কারও কথায় কর্ণপাত করতে চাইছে না।’ তাঁর পরামর্শ, এক্ষেত্রে মেয়েদের পড়াশোনার বাইরে গান, যোগব্যায়াম, অঙ্কন চর্চার মতো বিষয়গুলিতে অংশগ্রহণ করাতে হবে, যাতে তাদের মনের মধ্যে সুস্থ বিষয় ঘোরাফেরা করে।
পরপর নাবালিকা নিখোঁজের ঘটনায় চিন্তায় সিতাইয়ের বাসিন্দা পাঞ্চালী রায়। তাঁর কথায়, ‘নিজের মেয়ে রয়েছে, এরফলে স্বাভাবিকভাবে চিন্তা তো হয়ই। তবে এক্ষেত্রে পুলিশ প্রশাসন ও স্থানীয় প্রশাসনকে যৌথ উদ্যোগে বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। নয়তো আগামীতে এধরনের ঘটনা ক্রমে বেড়েই চলবে।’