দীপেন রায়, মেখলিগঞ্জ: পড়শি দেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক নিয়ে রোজই প্রশ্ন উঠছে। এই সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেকের মধ্যেই আশঙ্কা। এমনটা হোক, সানিয়াজান কিন্তু মোটেও চায় না। আর তাই কোচবিহারের (Cooch Behar) মেখলিগঞ্জ (Mekhliganj) সীমান্তে মোট ১৬ কিলোমিটার এলাকায় ১৩ বার সে দুই দেশকে ছুঁয়ে নিজের মতো করে বয়ে চলেছে। বিভেদের মাঝেও এই নদী যেন মহামিলনের বার্তা দিয়ে চলেছে।
মেখলিগঞ্জের পার্শ্ববর্তী ব্লক ময়নাগুড়ির পুঁটিমারির নালা থেকে নদীটির উৎপত্তি। সেখান থেকে ১৩ কিলোমিটার বয়ে মেখলিগঞ্জের বিএস বাড়ি এলাকা দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছে। তারপর একবার ভারত আর একবার বাংলাদেশ এভাবে চলে শেষে বাংলাদেশের তিস্তায় মিলিত হয়েছে৷ এই নদীর একেঁবেঁকে চলায় সীমান্তের নিরাপত্তা যেমন বিঘ্নিত হচ্ছে তেমনি কুচলিবাড়ি থানা এলাকার বাগডোকরা-ফুলকাডাবরি ও কুচলিবাড়ি গ্রাম পঞ্চায়েতের যোগাযোগ ব্যবস্থাও সমস্যার মুখে পড়েছে। সেখানে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে কাঁটাতারের বেড়া রয়েছে। কিন্তু নদীর জন্য বিএস বাড়ি থেকে ১০৯ ব্রহ্মোত্তর বিএসএফ ক্যাম্প পর্যন্ত সিপিডব্লিউডি’র রাস্তায় ১৩টি সেতু তৈরি করতে হয়েছে। সানিয়াজান নদীতে আগে এত সেতু ছিল না। কাঁটাতারের বেড়া তৈরির পর বেশ কিছু বছর আগে সিপিডব্লিউডি এই সেতুগুলি একসঙ্গে তৈরি করে। বিএসএফের উত্তরবঙ্গের এক আধিকারিকের বক্তব্য, ‘সীমান্তের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতেই কাঁটাতারের বেড়া ও সিপিডব্লিউডি’র রাস্তা তৈরি হয়েছে। সেই সময় এই সেতুগুলি তৈরি করা হয়। এই সেতুগুলির জন্য আমাদের বাড়তি জওয়ানের প্রয়োজন হয়।’
ভোটপট্টি-জোড়পাকরি গ্রামীণ সড়কে প্রথম সেতুটি রয়েছে। তারপর হেলাপাকড়ি ভোটপট্টি রাজ্য সড়কে দ্বিতীয় সেতু। এরপর জোরপাকরি-জালিয়াটারি মোড় গ্রামীণ সড়কে সেতু। তারপরই একেবারে মেখলিগঞ্জের বিএস বাড়ি সংলগ্ন রাজ্য সড়কে সেতু। এরপর কাঁটাতারের বেড়া ঘেঁষে যাওয়া রাস্তার পাশ দিয়ে যাত্রা শুরু। সিপিডব্লিউডি রাস্তার কসালডাঙ্গা সেতু সংলগ্ন এলাকা দিয়ে সানিয়াজান বাংলাদেশে ঢুকেছে। এরপর আবার খরখরিয়া সেতু সংলগ্ন এলাকা দিয়ে ভারতে ঢুকেছে। খরখরিয়ার পর গোলাপাড়া। তারপর ভারতের রাস্তার ওপর কাংড়াতলি, ডাকুরহাট দুটি সেতুর পর বক্সিরটারি হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এভাবে একে একে দরগাবাড়ি বারুণিমেলার মাঠ সংলগ্ন জেলা পরিষদ রাস্তার ওপর ও সংলগ্ন সিপিডব্লিউডি রাস্তার সেতু সংলগ্ন এলাকা দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছে। এরপর কলসি সেতু দিয়ে ভারতে ঢুকেছে। এরপর ভীষ্ম, চেমড়াভিটা, বাজেজমা, বল্টুরবাড়ি সেতু দিয়ে বারবার দুই দেশে ঢুকে–বেরিয়ে শেষে ১০৯ ব্রহ্মোত্তর কুচলিবাড়ি সেতুর পর একেবারেই বাংলাদেশে চলে গিয়েছে। খানিক দূরে সানিয়াজান নদী তিস্তায় মিশেছে।
সেতুগুলিকে কেন্দ্র করে পাচার, অনুপ্রবেশের মতো নানা সমস্যা রয়েছে। এই সমস্যা মেটাতে বিএসএফ অবশ্য সতর্ক। বাগডোকরা-ফুলকাডাবরির কাংড়াতলি ও ডাকুরঘাটের সেতু দুটির অবস্থা বেহাল হয়েছে। এই দুটি দিয়ে ভারী গাড়ির চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ১০১ ফুলকাডাবরিতে একটি সেতু রয়েছে। সেই সেতুও দুর্বল, সেতুর মুখে রাস্তা ধসে গিয়েছে।
কয়েকটি সেতুতে নদীর বিড়ম্বনা হলেও কুচলিবাড়ি থানা এলাকায় নদীর গুরুত্ব অপরিসীম। ছোট নদী হলেও এতে গোটা বছরই জল থাকে। এখানে দেশীয় মাছের স্বর্গরাজ্য। এলাকার বেশিরভাগ মৎস্যজীবী গোটা বছর নদীতে মাছ ধরে সংসার চালান। পাশাপাশি, সানিয়াজানের পাড়ে একাধিক চা বাগান গড়ে উঠেছে। সেই চা বাগান সহ পার্শ্ববর্তী কৃষিজমিতে সেচের একমাত্র ভরসা এই নদীই। আবার নদীবক্ষে ধান চাষ নিষিদ্ধ হলেও পলিময় সানিয়াজান নদীতে উচ্চমানের ধান চাষ হয়। নদীর পাড়ের কৃষকরা নদীবক্ষে ধান চাষ করেই সারাবছরের অন্ন জোগান। এই নদীতে নিয়ে স্কুল শিক্ষক সন্তোষ রায় বা ভূগোলের গবেষক সফিকুল ইসলামদের গর্বের শেষ নেই। সফিকুলের কথায়, ‘দুই দেশের মধ্যে এত কম দূরত্বে এভাবে একেবেঁকে চলা সাধারণত দেখা যায় না।’ সন্তোষ বললেন, ‘সানিয়াজান হয়তো দুই দেশকে এভাবেই এক করে রাখতে চায়। আজীবন।’