কোচবিহার: ‘বন্দি’ থাকার ধারণাটাই এখানে অন্যরকম। সাজাপ্রাপ্তরা বাইরের দুনিয়ায় বিনা বাধায় মিশে যাবেন। কাজ করবেন, উপার্জন করবেন। প্রায় স্বাভাবিক জীবনই কাটাবেন। তফাত খালি একটা জায়গায়, রাতে একটা নির্দিষ্ট সময় তাঁদের ফিরে আসতে হবে সংশোধনাগারের পাঁচিল ঘেরা চত্বরে। এই সংশোধনাগারকে বলা হয় মুক্ত সংশোধনাগার। পশ্চিমবঙ্গের চারটি জেলায় এমন মুক্ত সংশোধনাগার রয়েছে। এবার কোচবিহারে তৈরি হতে চলেছে রাজ্যের পঞ্চম মুক্ত সংশোধনাগার। চলতি মাসের ১৫ তারিখে প্রশাসনিক স্তরে সেই সংশোধনাগারের জন্য জায়গা পরিদর্শন করা হয়েছে।
মুর্শিদাবাদের লালগোলায় রয়েছে রাজ্যের সবথেকে পুরোনো মুক্ত সংশোধনাগারটি। রয়েছে মেদিনীপুর ও দুর্গাপুরে। আর উত্তরবঙ্গে এতদিন যাবৎ কেবল একটিই মুক্ত সংশোধনাগার ছিল, রায়গঞ্জে। কোচবিহারে গড়া হলে তা হবে উত্তরবঙ্গের দ্বিতীয় মুক্ত সংশোধনাগার। একথা জানিয়েছেন কোচবিহার সংশোধনাগারের জেলার গৌতম রায়। যেহেতু রায়গঞ্জের পরে এদিকে আর কোথাও কোনও মুক্ত সংশোধনাগার নেই, তাই কোচবিহারে মুক্ত সংশোধনাগার তৈরি হলে শুধু এই জেলাই নয়, আশপাশের জলপাইগুড়ি এবং আলিপুরদুয়ারের সাজাপ্রাপ্তদেরও সুবিধে হবে।
কারেকশনাল সার্ভিসেস ওয়েস্ট বেঙ্গল বা সিএসডব্লিউবি-র এআইজি (অ্যাডিশনাল ইনস্পেকটর জেনারেল) সুদীপ্ত চক্রবর্তী বলেন, ‘কোচবিহার জেলার সংশোধনাগারটিতে অনেকটা জায়গা রয়েছে। বেশ কিছু ঘরও আছে। তবে মুক্ত সংশোধনাগারের জন্য আরও কিছু পরিকাঠামো তৈরি করতে হবে।’
এভাবে খোলা অবস্থায় থাকলে সাজাপ্রাপ্তরা পালিয়ে যায় না? উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, আজ পর্যন্ত কোনও মুক্ত সংশোধনাগার থেকে কোনও আবাসিক পালানোর রেকর্ড নেই। জানালেন সুদীপ্ত।
মুক্ত সংশোধনাগারটি বদ্ধ সংশোধনাগার চত্বরের মধ্যে থাকলেও সংশোধনাগারের বন্দিদের সঙ্গে তাঁদের কোনওরকম সংযোগ থাকে না। সংশোধনাগার চত্বরের মধ্যে আলাদা একটি ক্যাম্পাস করে তাঁদের রাখা হয়। এক্ষেত্রে তাঁদের সাজা কাটানোর সময় রাতের থাকাটা শুধু সরকারি পয়সায় হয়। এখানে আসার পর প্রথম তিন মাস খাবার জেলা সংশোধনাগার থেকেই দেওয়া হয়। তারপর থেকে নিজের খাবারের খরচ নিজেকেই জোগাড় করতে হয় চাকরি বা অন্য কোনও কাজ করে। এখানকার সাজাপ্রাপ্তদের সকাল ৯টায় বের হয়ে রাত ৮টার মধ্যে সংশোধনাগারে ফিরে আসতে হয়। এই সংশোধনাগারে উদ্দেশ্য হল, সাজার মেয়াদ কাটানোর পর যাতে তাঁদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে কোনওরকম অসুবিধা না হয়।
যে কেউ এই মুক্ত সংশোধনাগারে থাকতে পারে? না। কারা এখানে থাকতে পারবে, সেটা ঠিক করার জন্য রয়েছে একটি বোর্ড। সেই বোর্ডে থাকেন এআইজি, ডিআইজি, সেন্ট্রাল জেল সুপার সহ অনেকেই। যাবজ্জীবন বা ওই ধরনের সাজাপ্রাপ্ত বন্দিদেরই সাধারণত মুক্ত কারাগারের জন্য বেছে নেয় সেই বোর্ড। তবে এই মুক্ত সংশোধনাগারে থাকার জন্য সরকার কাউকে কোনওরকম জোর করে না। সেই সুযোগ পেতে বন্দিকেই আবেদন করতে হবে। এরপর ওই বোর্ডের সদস্যরা সংশোধনাগারে থাকাকালীন ওই বন্দির ব্যবহার, এতদিন ধরে তার কাজ করার ক্ষমতা সহ বিভিন্ন রেকর্ড খতিয়ে দেখে সিদ্ধান্ত নেন।
সাজাপ্রাপ্তদের বাড়ির কাছাকাছি মুক্ত সংশোধনাগারে রাখার চেষ্টা করা হয়। তবে সব ক্ষেত্রে সেটা সম্ভব হয় না। তাই যেখানে যেরকম ফাঁকা থাকে সেই রকম জায়গায় তাঁদের রাখা হয়। ভারতবর্ষের বাইরে আমেরিকা, ইংল্যান্ড, জার্মানি, আয়ারল্যান্ড, ফিলিপাইন, স্কটল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া সহ বিভিন্ন জায়গায় এই মুক্ত কারাগার রয়েছে। ভারতীয় বিভিন্ন রাজ্যেও মুক্ত কারাগারের সুবিধে রয়েছে।