প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়, বর্ধমানঃ হিন্দু-মুসলিম পড়ুয়াদের জন্য আলাদা আলাদা হেঁসেল। সেই পৃথক হেঁসেলেই বছরের পর বছর চলছে প্রাথমিক স্কুলে মিড-ডে মিলের রান্না। এই চিত্র অন্য কোথাও নয়, পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব বর্ধমান জেলার একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ঘটনা। এই ঘটনাটি জানাজানি হতেই রাজ্যে তুমুল শোরগোল পড়ে গিয়েছে জেলা জুড়ে। নড়েচড়ে বসেছে জেলা ও ব্লক প্রশাসন থেকে স্থানীয় পঞ্চায়েত এবং প্রাথমিক শিক্ষা সংসদ। জেলাশাসক আয়েশা রাণী বিষয়টি নিয়ে তিনি মহকুমা শাসককে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। তদন্ত রিপোর্ট হাতে আসার পর তা খতিয়ে দেখে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে জেলাশাসক জানিয়েছেন।
ঘটনাটি কিশোরীগঞ্জ-মনমোহনপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের। বিদ্যালয়টি পূর্ব বর্ধমান জেলার পূর্বস্থলী ১ নম্বর ব্লকের নাদনঘাট থানা এলাকায় অবস্থিত। প্রাক প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত বিদ্যালয়ে পড়ুয়ার সংখ্যা ৭২ জন। শিক্ষক ও শিক্ষিকা মিলিয়ে রয়েছেন চারজন। হিন্দু-মুসলিম, উভয় সম্প্রদায়ের পরিবারের ছেলে মেয়েরা এই স্কুলের শ্রেণীকক্ষে একসঙ্গে বসে শিক্ষকের কাছে পাঠ নেয়। তা নিয়ে অবশ্য কোনও বিভেদ নেই। তবে ’বিভেদ’ চরম রূপ পেয়েছে এই বিদ্যালয়ের মিড- ডে মিল নিয়ে। এই বিদ্যালয়ে হিন্দু-মুসলিমদের জন্য আলাদা আলাদা মিড-ডে মিল রান্নার হেঁসেল ঘর রয়েছে। সেখানে রান্নাও করেন দুই সম্প্রদায়ের রাঁধুনি। এই কথা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তাপস ঘোষও অস্বীকার করতে পারেননি।
স্কুলের রাঁধুনিদের একজন হিন্দু, অপরজন মুসলিম। তাঁরাই জানিয়েছেন, বিদ্যালয়ে মিড-ডে মিল রান্নার হেঁসেল আলাদা। হিন্দু রাঁধুনি সোনালী মজুমদার আলাদা গ্যাসের উনানে রান্না করেন হিন্দু পরিবারের পড়ুয়াদের মিড-ডে মিল। আর অপর গ্যাসের উনানে মুসলিম রাঁধুনি গেনো বিবি রান্না করেন মুসলিম পরিবারের পড়ুয়াদের মিড-ডে মিল। শুধু আলাদা আলাদা ভাবে রান্না করাই নয়, হেসেলে দুই সম্প্রদায়ের পড়ুয়াদের মিড-ডে মিল রান্নার উপকরণ থেকে শুরু করে বাসনপত্র, হাঁড়ি, কড়াই, খুন্তি-সেসবও আলাদা আলাদা রয়েছে। এমনকী হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের ৪৩ ও ২৯ জন পড়ুয়াকে মিড- ডে মিল খাওয়ানোও হয় আলাদা আলাদা স্থানে বসিয়ে।
পূর্বস্থলীর নসরৎপুর পঞ্চায়েতের প্রধান কানন বর্মন মঙ্গলবার জানান, বিদ্যালয়টিতে মিড ডে মিল চালু হওয়ার পর থেকেই এমন ঘটনা চলে আসছে বলে এখন জানতে পেরেছেন। এমন কালচার যাতে বন্ধ হয়, তার জন্য প্রশাসনের সর্বোচ্চ মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করবেন বলে প্রধান জানিয়েছেন। আর পূর্বস্থলী ১ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি দিলীপ মল্লিক বলেন, “শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এমন ঘটনা কখনই কাম্য নয়। রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুল ইসলামকে নিয়ে গর্বিত বাংলায় এমন ঘটনা কার্যতই বেমানান। অবিলম্বে এসব বন্ধ হওয়া দরকার।“
এ নিয়ে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তাপস ঘোষ বলেন, “আমি মাত্র একবছর হল এই স্কুলে এসেছি। তার অনেক আগে থেকেই স্কুলে এইভাবে মিড ডে মিল রান্না হচ্ছে। একারণে মিড-ডে মিলের খাতে দ্বিগুণ খরচা হচ্ছে। এটা যাতে বন্ধ হয়, তার জন্য বুধবার তিনি বুধবার বিদ্যালয়ে অভিভাবকদের বৈঠক ডেকেছি।” এলাকার প্রবীণ বাসিন্দা গণেশ গোঁসাই বলেন,“স্কুলের খুদে পড়ুয়াদের মধ্যে ধর্মীয় ভেদাভেদ থাকাটা ঠিক নয়। সরকারী স্কুলে হিন্দু ও মুসলিম ঘরের পড়ুয়াদের জন্য আলাদা আলাদা করে মিড রান্না বন্ধ হোক, এটা আমিও চাই। কারণ ধর্ম নিরেপেক্ষতাই আমাদের ভারতবর্ষের গর্ব।“