কল্লোল মজুমদার, মালদা: খড়ির উনুনের ওপরে ভাত চাপানো। সঙ্গে গোটা চারেক আলু। পাইপে ফু দিয়ে উনুনের আগুনকে আরও উসকে দিচ্ছিলেন দুর্গা মণ্ডল। ওই সময় তাঁকে প্রশ্ন করা হল, বাড়িঘরে জল ঢুকেছে কবে? উনুনের দিক থেকে মুখ না তুলে দুর্গা বলেন, ‘আবার তোরা এসেছিস…। আগে নদী বাঁইধা দে ..। তারপর ভোট দেব।’
পরক্ষণেই মুখ তুলে নেতাদের দেখতে না পেয়ে বছর ৫০-এর ওই মহিলা বলে ওঠেন, ‘কী আর করব। এই তো সাতদিন হল কেশরপুর বাঁধে এসে আশ্রয় নিয়েছি। নেতারা এসে কেউ দিল্লির সরকার আবার কেউ কলকাতার সরকারকে দায়ী করেন। আর এদিকে আমরা জলে ডুবে মরি।’
এদিকে, ভাতের ফ্যান হাঁড়ি উপচে পড়ে উনুনটা নিভে গেল। যেন মনে হল, মনের কথা বলে ওই উনুনের মতো তাঁরও মনের ব্যথার আগুনটা কিছুটা হলেও নিভিয়ে ফেললেন দুর্গা।
ভূতনির (Bhutni) কেশরপুর বাঁধের দু’ধারে ছয়টি খুঁটির ওপর দাঁড়িয়ে সারি সারি অস্থায়ী আস্তানা। মাথার ওপর সরকারি ত্রিপল। তার সামনেই প্রবল গতিতে বয়ে চলেছে কোশী, ফুলহর আর গঙ্গা। এলাকার মানুষ গঙ্গাকে বলে বড় নদী। নদীর ধারে আসমান শেখ আকাশের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
ভাঙন নিয়ে তাঁকে প্রশ্ন করতেই ক্ষোভের সঙ্গে তিনি বলে উঠলেন, ‘নেতারা আসেন। আমাদের ছবি তোলেন তারপর চলে যান। ফের ভোটের সময় ওদের দেখা যায়।’
প্রতি বছর ভূতনির বিস্তীর্ণ এলাকা একটু একটু করে নদীগর্ভে চলে যাচ্ছে। এতে ভিটেমাটিছাড়া হচ্ছেন হাজার হাজার পরিবার। ভাঙন রোধের অজুহাতে কোটি কোটি টাকা খরচের নামে সব টাকা চলে যায় গঙ্গার গর্ভে। প্রতিবছর ত্রাণের জন্য হাহাকার ওঠে।
রাজ্যের শাসকদলের অভিযোগ, ভাঙন রোধে কেন্দ্র টাকা দেয় না। কেন্দ্রের শাসকদলের অভিযোগ, রাজ্য জমি দেয় না। রাজ্যের ভাঙন সমস্যা নিয়ে সমাধানের কোনও আগ্রহ নেই।
সত্যিই কি ইদানীংকালে মালদা জেলায় বন্যা আর ভাঙন রোধ নিয়ে সেভাবে কোনও জোরদার আন্দোলন হয়েছে? সেভাবে হলে হয়তো এতদিন বন্যা ও ভাঙন রোধে কিছু একটা সমাধান হত।
যদিও অনেকের মতে ২০০৩ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি ভাঙন রোধ আর পুনর্বাসনের দাবিতে শেষবারের মতো আন্দোলন হয়েছিল মালদায়। সেই সময় মালদায় নদী আন্দোলনের অন্যতম মুখ মেধা পাটকরকে নিয়ে এসেছিলেন তৎকালীন বাম সরকারের মন্ত্রী শৈলেন সরকার। মোথাবাড়িতে পদযাত্রা করে গর্জে উঠেছিলেন মেধা পাটকর। এরপর কিছুদিন আন্দোলন চললেও ধীরে ধীরে তা থেমে যায়।
বিভিন্ন গবেষণাপত্রে রাজ্যের নদী আন্দোলনের ইতিহাসে ওই দিনটি অন্যতম বলে উল্লেখ করা রয়েছে। এরপরে ১৯৯৬ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী দেবেগৌড়া, মালদা এসে ভাঙন ও বন্যা প্রতিরোধ নিয়ে একটি কমিটি গঠনের সুপারিশ করেন। এর বাইরে মালদার ভাঙন ও বন্যা প্রতিরোধে তেমন কোনও উল্লেখযোগ্য কিছু নেই।
সোমবার সন্ধ্যায় ভূতনির গোবর্ধনটোলা বাজারের মাঠে সভা করছিল সিপিএম। তাদের সভার বিষয় ছিল ভূতনি বাঁচাও। সেখানে বক্তব্য রাখছিলেন সিপিএম নেতা দেবজ্যোতি সিনহা। সভা শেষে জনতার ভিড় থেকে তাঁর উদ্দ্যেশ্যে প্রশ্ন ছুড়ে দেওয়া হয়, এসব আন্দোলন, সভা কি শুধু ভোটের দিকে লক্ষ্য করে? তাঁর কাছ থেকে জবাব আসে, বর্তমানে আমরা ক্ষমতায় নেই। কিন্তু মানুষের পাশে রয়েছি। ২৫ অগাস্ট ভূতনি বাঁচানোর ডাক দিয়ে বানভাসি মানুষদের নিয়ে আমরা সেচ দপ্তর ঘেরাও করব। প্রয়োজনে রাতভর ঘেরাও চলবে।
যদিও উত্তর মালদার বিজেপি সাংসদ খগেন মুর্মু বললেন, ‘আমি লোকসভায় বেশ কয়েকবার মালদার ভাঙন আর বন্যা নিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। কিন্তু সমস্যা সমাধানে রাজ্য সরকারের কোনও উদ্যোগ নেই। ভাঙন প্রতিরোধের জন্য কেন্দ্রের কাছে আবেদন করতে হবে রাজ্যকে। আবেদন করলে টাকা আনার দায়িত্ব আমার।’
তৃণমূলের জেলা সভাপতি আব্দুর রহিম বক্সীর মন্তব্য, ‘বিজেপি নেতারা শুধু মিথ্যা কথা বলে মানুষের সঙ্গে মানুষের বিভেদ তৈরির চেষ্টা করেন। ভাঙন রোধের জন্য কেন্দ্র কিছুই করছে না। রাজ্য সরকার সীমিত ক্ষমতার মধ্যেও সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করে চলেছে।’
ভাঙন ও বন্যা রোধে এমন রাজনৈতিক কচকচানিতে ভূতনির আকাশে-বাতাসে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে দুর্গার সেই অমোঘ বাণী। আগে নদী বাঁইধা দে …।