ঢাকা : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সাফাই নাকচ হয়ে যাচ্ছে সেনাপ্রধানের বক্তব্যে। তাছাড়া বাংলাদেশ সরকারের অন্দরে ও সমর্থক শক্তির মধ্যে সংঘাতও বেআব্রু হল তাঁর মন্তব্যে। সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামানের বক্তব্যে কার্যত বাংলাদেশে বর্তমান নৈরাজ্যে সিলমোহর পড়ল। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার ব্যাখ্যাও দিয়েছেন তিনি। সেনাপ্রধানের কথায়, ‘প্রথম কারণ, আমরা নিজেরা হানাহানিতে, একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে বিষোদ্গারে ব্যস্ত।’
যে পরিস্থিতি অপরাধীদের সুযোগ এনে দিয়েছে বলে তিনি মনে করেন। ‘আমরা একটা অরাজক পরিস্থিতির মধ্যে আছি’ কবুল করে ওয়াকার বলেন, ‘অপরাধীরা খুব ভালোভাবেই জানে যে, এই সময়ে অপরাধ করলে সহজে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব।’ ২৪ ঘণ্টা আগে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মহম্মদ জাহাঙ্গির আলম চৌধুরী কিন্তু দাবি করেছিলেন, বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা সরকারের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। মঙ্গলবার সেনাপ্রধান বুঝিয়ে দিলেন, এমনকি পুলিশ ও অন্য নিরাপত্তাবাহিনীগুলিও ঠিকমতো কাজ করতে পারছে না।
বাংলাদেশজুড়ে ডামাডোলের পরিস্থিতির মধ্যে মঙ্গলবার পদত্যাগ করলেন অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার এবং ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তির দুটি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম। তিনি বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম নেতা ছিলেন। শুক্রবার দেশে যে নতুন দলের জন্ম দিতে চলেছে জুলাই অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত পড়ুয়ারা, নাহিদ তার নেতৃত্ব দেবেন বলে জল্পনা ছড়িয়ে পড়েছে।
জাতীয় সেনা শহিদ দিবস উদযাপন উপলক্ষ্যে ঢাকায় মঙ্গলবার এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘পুলিশের ঠিকমতো কাজ না করার কারণ হল, অনেকের বিরুদ্ধে মামলা, অনেকে জেলে আছেন। র্যাব, বিজিবি, ডিজিএফআই, এনএসআই উদ্বিগ্ন হয়ে আছে। তাঁদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দোষারোপ- গুম, খুন ইত্যাদি। অবশ্যই সেসবের তদন্ত হবে। কিন্তু যেন এই সংস্থাগুলিকে অবমাননা না করা হয়। সংস্থাগুলির মর্যাদা নষ্ট করে যদি মনে করেন যে, দেশে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় থাকবে, তাহলে আমি পরিষ্কার বলে দিচ্ছি, সেটা সম্ভব নয়।’
এই নিয়ে পরপর দু’দিন সেনাপ্রধানের বক্তব্য বাংলাদেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে ইঙ্গিতপূর্ণ। সোমবার তিনি বলেছিলেন, নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় না আসা পর্যন্ত সেনাবাহিনী ক্যান্টনমেন্টে ফিরবে না। মঙ্গলবার তিনি স্পষ্ট করে সরকারের ভেতরে ও বাইরে সমর্থকদের মধ্যে সংঘাতের বাতাবরণের দিকে আঙুল তুললেন। ওয়াকার স্পষ্ট সতর্কবার্তা দিলেন, ‘আপনারা নিজেরা যদি মারামারি-কাটাকাটি করেন, তাহলে দেশ ও জাতির সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হবে।’
শুধু তাই নয়, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকার ব্যর্থ হলে শেষপর্যন্ত সেনাবাহিনীর ক্ষমতা হাতে নেওয়ার আভাসও ছিল ওয়াকারের মন্তব্যে। তিনি বলেন, ‘বিশ্বাস করুন, আমরা (সেনা) নেতৃত্ব দিতে চাই না। তাই আপনাদের সতর্ক করে দিচ্ছি। পরে বলবেন সতর্ক করিনি। আমরা কাজ করে যাচ্ছি। সতর্ক করে দিচ্ছি, সেনাবাহিনীকে প্রতিআক্রমণ করবেন না।’
নতুন যে দল তৈরি হতে চলেছে, তাতে তাঁর নেতৃত্বের ব্যাপারে নাহিদ নির্দিষ্ট কিছু তথ্য না দিলেও আভাস স্পষ্ট। পদত্যাগী উপদেষ্টার কথায়, ‘দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে একটি রাজনৈতিক শক্তির উত্থানের জন্য আমার রাজপথে থাকা প্রয়োজন, ছাত্র-জনতার সঙ্গে এক কাতারে থাকা দরকার। গণ অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারীদের শক্তি সংহত করতে আমি মনে করেছি, সরকারে থাকার চেয়ে আমার সরকারের বাইরে থাকা উচিত।’
বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে যাঁরা চর্চা করেন, তাঁরা নিশ্চিত যে, ভোট হলে ক্ষমতায় চলে আসতে পারে বিএনপি। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা এবং বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা তা হতে দিতে চান না। তাঁদের সঙ্গে আছে জামায়াতের মতো মৌলবাদী সংগঠনগুলি। এর আগে জামায়াতে এককভাবে সমমনোভাবাপন্ন দলগুলিকে একত্রিত করতে ব্যর্থ হয়েছে চেষ্টা করেও। তাই শেষ পর্যন্ত ছাত্র নেতাদের সামনে রেখে নতুন দল গড়ার চেষ্টা হচ্ছে।
কিন্তু তাতে পরিস্থিতি উলটে ঘোরালো হয়ে উঠতে পারে বলে আভাস দিচ্ছেন খোদ সেনাপ্রধান। তাঁর কথায়, ‘এখানে যেসব উচ্ছৃঙ্খল কাজ হচ্ছে, তা আমাদের তৈরি করা। এই বিপরীতমুখী কাজ করলে দেশে কখনও শান্তিশৃঙ্খলা আসবে না।’