সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: চলতি বছরের প্রায় ৬ মাসে পুলিশের খাতায় রেকর্ড নেই এমন দুর্ঘটনার সংখ্যা কম-বেশি ৪০। তবে ওই ঘটনাগুলিতে বহু মানুষজন জখম হলেও মারা যাননি কেউ। আর রেকর্ড রয়েছে এমন সংখ্যা শুক্রবারের সাত সকালের ঘটনা নিয়ে ৩টি। যেখানে মারা গিয়েছেন ১০ জনের বেশি। সব মিলিয়ে ৪৩ দুর্ঘটনাস্থল পুরুলিয়া- জামশেদপুর ১৮ নম্বর জাতীয় সড়কে বলরামপুর কলেজ মোড় থেকে উরমা হাটতলা পর্যন্ত ৫ কিমি রাস্তা। এর মধ্যেই রয়েছে জাতীয় সড়কের দু’পাশ থেকে আসা ঢালু হয়ে যাওয়া কালো পিচ। রয়েছে মৃত্যুফাঁদ নামশোল প্রাথমিক বিদ্যালয় এলাকার বাঁক।
সংখ্যা, তত্ত্ব, পরিসংখ্যানে এখানেই শেষ নয়। ২০২৪ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর মাসেও এই এলাকায় দুর্ঘটনায় একাধিক জন জখম হয়েছেন। তাই নামশোলের এই এলাকার নাম হয়ে গিয়েছে ‘দুর্ঘটনাপুর’! সেই সঙ্গে এই এলাকায় অভিশপ্ত তকমা দিয়ে চাউর হয়ে গিয়েছে ভূতের গল্প। দিনে রাতে ভূত ঘুরছে এই কথা হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে এমনই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যে এলাকা দিয়ে পার হলেই চালকরা রীতিমত পেন্নাম ঠুকছেন। এদিনের ঘটনার পর এলাকার মানুষজন বলরামপুর থানার কাছে প্রস্তাব রাখেন, ওই এলাকার ভূতকে শায়েস্তা করতে কালি মন্দির গড়তে চান! যা শুনে রীতিমতো হতবাক পুলিশ।
পুলিশ জানিয়েছে, মৃত ৯ জনের নাম কৃষ্ণপদ মাহাতো (৩৬), বিজয় মাহাতো (৪৮), অজয় মাহাতো (৪২), বৃহস্পতি মাহাতো ( ৪৫), স্বপন মাহাতো (২৭), চিত্তরঞ্জন মাহাতো (২৪), চন্দ্রমোহন মাহাতো (৫০), গুরুপদ মাহাতো (৩১), শশাঙ্কশেখর মাহাতো (৩০) ।
কেন এই এলাকা দুর্ঘটনাপ্রবণ হয়ে গেল? পুলিশ বলছে, নামশোল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে যেমন একটি বাঁক রয়েছে। তেমনি দু পাশের রাস্তা একেবারে ঢালু হয়ে মিশে গিয়েছে। এলাকার মানুষজন বলছেন, ওই এলাকায় যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রণের কোন বোর্ড দেয়নি জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষ। অথচ এই রাস্তার দুদিকে আমরুহাসা ও হনুমাতা নদীর ওপর তিন কিমির মধ্যে দুটি সেতু রয়েছে। সেখানে অবশ্য চল্লিশ কিমি প্রতি ঘন্টায় গতি নিয়ন্ত্রণের কথা বলা আছে। সাধারণভাবে জাতীয় সড়কে ৮০ থেকে ১২০ কিলোমিটার ঘন্টায় যাওয়ার বিধি নিষেধ থাকে। কিন্তু ওই এলাকায় জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষের তরফে কোন বোর্ড দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ। তাই এদিন প্রশাসনের তরফ থেকে জাতীয় সড়কের কাছে প্রস্তাব পাঠানো হয় ওই এলাকায় প্রায় ১০-১২ টি হাম্প দেওয়ার।
কিন্তু তাতে সাড়া দেয়নি জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষ। তারা জানান, জাতীয় সড়কে তারা হাম্প দিতে পারবেন না। সেখানে সচেতনতামূলক একাধিক বোর্ড দেবেন। তাহলে কি কমবে দুর্ঘটনা? উত্তর মেলেনি। কিন্তু এলাকার মানুষজন বলছেন ওখানে ভূত ঘুরছে। ভূতকে তাড়ানোর জন্য পূজার্চনা দরকার।
এদিকে এই দুর্ঘটনার পরে মৃত চন্দ্রমোহন মাহাতোর খুড়তুতো ভাই ঝাড়খণ্ডের সরাইকেলা খরসোওয়া জেলার নিমডি থানার রঘুনাথপুরের বাসিন্দা উমাপদ মাহাতো এফআইআর দায়ের করেন। সেই ঘটনার ভিত্তিতে তদন্ত শুরু করেছে বলরামপুর থানার পুলিশ। নামশোল গ্রামের বাসিন্দা সীতারাম মাহাতো, শিকারি মাহাতো বলেন, “এত দুর্ঘটনা কেন ঘটছে? বুঝতে পারছি না। নিশ্চয়ই কোন না কোন বিষয় আছে।”
তবে ওই এলাকার বাসিন্দা ধীরেন প্রামাণিক বলছেন, “ঝাঁ চকচক জাতীয় সড়ক যখন হয়েছে তখন থেকেই এখানে দুর্ঘটনা বাড়ছে। কোথাও কোন যান নিয়ন্ত্রণের বোর্ড নেই। তাই বোধ হয় ১২০ কিমি গতিবেগের ওপরেও ছুটছে গাড়ি। যে এলাকাটা দুর্ঘটনাপ্রবণ হয়ে উঠেছে সেই এলাকার দু’পাশের রাস্তা একেবারে ঢালু। বিষয়টি নিয়ে জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষকে ভাবনা চিন্তা করতে হবে।” এই জাতীয় সড়ক ঝাঁ চকচকে হওয়ার পর শুধু নয়। যখন মেরামত চলছিল তখনও একাধিকবার দুর্ঘটনা ঘটে। সবে মিলিয়ে ‘দুর্ঘটনাপুর’-এ এখন ভূতের আতঙ্ক!
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন