হারিয়ে যাচ্ছে ভাদু উৎসব ও গান

হারিয়ে যাচ্ছে ভাদু উৎসব ও গান

ব্লগ/BLOG
Spread the love


সঞ্জয় সাহা

‘কাছের মানুষ দূরে থুইয়া,
মরি আমি ধড়ফড়াইয়া রে’

ভাদ্র মাসে মেয়েরা ভাদুলি ব্রত করে থাকে। এই ব্রত সেদিনের কথা মনে করিয়ে দেয়, যখন এদেশে সওদাগররা সপ্তডিঙা ভাসিয়ে সমুদ্রে বাণিজ্য করে ঘরে ফিরে আসত। ব্রতের ছড়ায় আজও সেই ছবিগুলো ধরা পড়ে থাকে। অবশ্য আজ আর সেই সওদাগর নেই। আজ সেই বাণিজ্যও নেই। কিন্তু এই ব্রতের ভেতর দিয়ে মনে পড়ে যায় সেই আপনজনের কথা যারা দূরে আছে। আর সেইসঙ্গে বাড়ির ঘরে অপেক্ষারত প্রেমিকার কথা ভেবে তার সাতসমুদ্রে পাড়ি দেওয়া প্রেমিক হয়তো এটাই বলত, ‘ওরে নীল দরিয়া, আমায় দেরে ছাড়িয়া,
একলা ঘরে মন বধুয়া আমার রইছে পন্থ চাইয়া।’

ভাদু উৎসব ভাদ্র মাসের উৎসব। ভাদ্র মাসের সংক্রান্তির দিনে ভাদুপুজো হয়ে থাকে। ব্রতের ক্ষেত্রে ভাদ্র মাসের প্রারম্ভেই শুরু হয় মেয়েলি ব্রত। পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, বীরভূম, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় এবং লাগোয়া বিহার, ঝাড়খণ্ডের দু’-একটা জেলায় প্রধানত ভাদু উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। বাংলার একটি ঐতিহ্যবাহী লোক উৎসব এই ভাদু উৎসব, যা বাংলা লোকসংস্কৃতি থেকে বর্তমানে হারানোর পথে।

আদিবাসী, সাঁওতালদের মধ্যে করম গান ও উৎসব পালন করার রীতি ছিল এই বর্ষাকালে। তা-ও আবার বিশেষভাবে ভাদ্র মাসে।

ভদ্রাবতী সম্বন্ধে জানা যায়, তিনি পুরুলিয়ার রঘুনাথগঞ্জ মহকুমার অন্তর্গত কাশীপুরের রাজা নীলমণি সিং দেওয়ের কন্যা।

১৮৫৮ সালে বিয়ের আগের দিন কোনও এক আকস্মিক কারণে তাঁর মৃত্যু হয়। ভদ্রাবতী ১৭ বছর বেঁচে ছিলেন। একমাত্র কন্যার মৃত্যুতে রাজা শোকাহত হয়ে পড়েন। প্রজাকুলের ইচ্ছায় মিত্র-মন্ত্রীদের সহযোগিতায় শুরু হয় ভাদুর স্মৃতি তর্পণ।

এখানে একটা কথা জানিয়ে রাখা ভালো, ভাদুর জন্ম এবং মৃত্যু দুই-ই ভাদ্র মাসে। তাই ভাদ্র মাসে হিন্দুদের কোনও বিবাহ থাকে না।

ধর্মীয় মতে, ভাদ্র মাসে যে রমণী লক্ষ্মীপুজো করেন তাঁর উপরে যশোলক্ষ্মী, ভাগ্যলক্ষ্মী, কুললক্ষ্মী প্রসন্ন হন। সেই সূত্রে মনে হয়, ভাদু আসলে শস্যদেবী। ধান ওঠার ফলে চাষিদের ঘরে শস্য বন্দনার যে রেওয়াজ ছিল, তা নানা বিবর্তনের ফলে গড়ে ওঠে ভাদুদেবী রূপে।

বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া জেলার পঞ্চকোট রাজপরিবারের রাজা নীলমণি সিং দেওয়ের তৃতীয় কন্যা ভদ্রাবতীর বিবাহের দিন বিবাহ করতে আসা পাত্র সহ বরযাত্রীগণ ডাকাত দলের দ্বারা খুন হলে ভদ্রাবতী হবু স্বামীর চিতার আগুনে প্রাণ বিসর্জন দেন। এই কাহিনী ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার পুরুলিয়া’ গ্রেন্থ প্রকাশিত হয়। প্রিয় কন্যাকে স্মরণীয় রাখতে রাজা নীলমণি ভাদু গানের প্রচলন করেন। যদিও রাজার তিন পত্নী ও দশ পুত্রের উল্লেখ থাকলেও কোনও কন্যাসন্তানের উল্লেখ নেই রাজপরিবারের বংশতালিকায়। ভাদু-উৎসব, ভাদু গানের লোককথা ও তার প্রেক্ষাপট কতটা প্রাসঙ্গিক? বর্তমান প্রজন্মের কাছে এই একটা প্রশ্ন থেকেই যায়।

(লেখক মাথাভাঙ্গার বাসিন্দা।)



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *