সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: ফুটবলে প্রচলিত কথা, ক্লাবের থেকে ব্যক্তি বড় নন। কিন্তু ক্লাব ও ব্যক্তি কখনও কখনও মিলেমিশে যান। মোহনবাগানের সঙ্গে স্বপনসাধন বোসের সম্পর্ককে এভাবেও ব্যাখ্যা করা যায়। ময়দান যাকে চেনে টুটু বোস নামে। তাঁকে এবার ‘মোহনবাগান রত্ন’-এ ভূষিত করা হল। এই সম্মান হাতে পেয়ে আবেগবিহ্বল তিনি। কখনও হাসলেন, কখনও স্মৃতিচারণ করলেন। কখনও বা কেঁদে ফেললেন। আর বললেন, ‘মনে হচ্ছে যেন হাতে চাঁদ পেয়েছি।”
নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে ‘মোহনবাগান দিবসে’র শ্রেষ্ঠ আকর্ষণ ছিল টুটু বোসকে ‘রত্ন’ সম্মানে ভূষিত করা। তিনি যখন মঞ্চে উঠছেন, তখন হাততালির রোল। তাঁকে নিয়ে ভিডিওবার্তায় বক্তব্য রাখেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়, বাইচুং ভুটিয়া, আইএম বিজয়ন, জোসে ব্যারেটো, সুব্রত ভট্টাচার্য প্রমুখ। যার মূল বক্তব্য, ‘টুটু বোস, দ্য গডফাদার’। তাঁকে সংবর্ধনা দেওয়ার আগে ভিডিওবার্তায় বলা হয়েছিল, তিনি সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো মানুষ। এই সম্মান যেন ‘গঙ্গাজলে গঙ্গাপূজা’। আসলে তাঁর আমল থেকেই ‘মোহনবাগান রত্ন’ দেওয়া শুরু হয়। ক্লাব সচিব সৃঞ্জয় বোস ও সভাপতি দেবাশিস দত্ত মিলে তাঁকে মোহনবাগান রত্নে ভূষিত করেন। মঞ্চে তখন চাঁদের হাট। হবে নাই বা কেন! তিনি যে সবুজ-মেরুনের প্রাণভোমরা টুটু বোস।
তিনি বলেন, “কেউ ফার্স্ট হলে তাঁকে সবাই বলত, কীরে হাতে চাঁদ পেয়েছিস? সেই ছোটবেলায় শুনেছিলাম, হাতে চাঁদ পাওয়ার গপ্পো। আজ এই রত্ন হাতে নিয়ে মনে হচ্ছে, আমি সত্যিই চাঁদ পেয়েছি।” তারপরই তাঁর চোখে জল। যেন প্রায় আশিতে পৌঁছনো একজন দক্ষ পোড় খাওয়া কর্মকর্তা নন। তিনি মোহনবাগানি, এটাই তাঁর একমাত্র পরিচয়।
কিন্তু কেন ইতিহাসে ‘টুটুদার’ কথা লেখা থাকবে? উত্তরটা সবাই জানেন। নতুন করে বলার নয়। টুটুবাবু স্মৃতিচারণ করতে থাকেন, কীভাবে তিনি ক্লাবে ভোটাধিকার চালু করেন। ভোট ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন এনে সাধারণ নির্বাচনের মতো করে ব্যালট পেপারে ভোট দেওয়ার পদ্ধতি চালু করেন। সেই ঐতিহাসিক নির্বাচন হাই কোর্টের অঙ্গনে হয়েছিল। তিনিই সচিব হয়েছিলেন। এছাড়া একটা প্রথা ছিল, মোহনবাগান বিদেশি প্লেয়ার সই করায় না। তিনি ঠিক করলেন ‘লোহাকে কাটে লোহা’। অতএব প্রথম বিদেশি হিসেবে সবুজ-মেরুনে এলেন চিমা ওকোরি। প্রথাভাঙা কার্যকলাপ নিয়ে কম কথা শুনতে হয়নি। কিন্তু মানুষটা বোধহয় এরকমই। ২০২০ সালে আরপিএসজি গ্রুপের কর্ণধার সঞ্জীব গোয়েঙ্কার সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধার মূল কারিগর তো তিনিই। গত মরশুমে মোহনবাগানের মাথায় দ্বিমুকুট। তিনি ঘোষণা করেন, “মোহনবাগান ক্লাব যাতে হাত দেয়, তা সোনা হয়ে যায়।”
এবছর ১৯ জনকে মোহনবাগানের আজীবনের সদস্যপদ দেওয়া হয়। আর নিয়ম অনুযায়ী মোহনবাগান রত্নকে এক লক্ষ টাকা পুরস্কার দেওয়া হয়। কিন্তু কর্মকর্তারা সেই চেকে সই করার সাহস দেখাতে পারেননি। টুটু বোস বলেন, “আমার মনটা চিরকাল সবুজ-মেরুন। এবার ১৯ জন আজীবনের সদস্যপদ পেয়েছেন। ১৯ কেন, ২০ জন হবে। আমি আরও চার লক্ষ টাকা দিচ্ছি, ২০তম লাইফ মেম্বার যেন পরজন্মে টুটু বোস হয়।”
তিনি আরেকটি অনুরোধও করেন বর্তমান ক্লাব কমিটিকে। তিনি বলেন, “আমি খেতে ভালোবাসি। এই ক্যান্টিন ৩০ লক্ষ টাকা দিয়ে আমি করে দিয়েছিলাম। আমি আর সুব্রত মুখোপাধ্যায় পাউরুটি-স্টু খেয়ে ওই ক্যান্টিন উদ্বোধন করেছিলাম। আমার মৃত্যু হলে দয়া করে ক্যান্টিনটা টুটু বোসের নামে করে দেবেন। আমার নাম মুছে দেওয়া যাবে না।” না, টুটুবাবু, আপনার নাম মুছে যাবে না। তিনি যখন ‘জয় মোহনবাগান’ বলে গর্জে উঠলেন, তখন তাতে সঙ্গ দিল গোটা নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়াম। যেন স্টেডিয়াম ভেঙে পড়ার জোগাড়। টুটুবাবু, আপনি মোহনবাগান সমর্থকদের কাছে মহানায়ক। যেভাবে আপনার হৃদয়ে চিরকাল সবুজ-মেরুন, তেমনই সমস্ত সবুজ-মেরুন সমর্থকের হৃদয়ে আপনি অমর, চিরশাশ্বত।