হরমুজ প্রণালী অথবা বঙ্গীয় তরমুজ প্রণালী

হরমুজ প্রণালী অথবা বঙ্গীয় তরমুজ প্রণালী

আন্তর্জাতিক INTERNATIONAL
Spread the love


 

  • বিপুল দাস

উঠতি কবি ঘনবরণ সাঁপুই জানত এবার সে শিয়োর মোহনার ঢেউ কাব্য সমারোহে কবিতা পাঠের ডাক পাবে। সেই হিসেবেই নতুন ধরনের পাঞ্জাবি কিনেছিল। বাড়িতে ট্রায়ালও দিয়েছে। কিন্তু পাঞ্জাবির সঙ্গে ধুতি, প্যান্ট, নাকি আলিগড়ি পাজামা পরবে, সেটাই ফাইনাল ডিসিশন নিতে পারছিল না। তিনটের সঙ্গেই ট্রায়াল দিয়েছে। কিন্তু তার চিরকালের শত্রু কৃষ্ণধন পোদ্দার ডাক পাচ্ছে কি না, এটা কনফার্ম জানতে না পেরে খুব দুশ্চিন্তায় ছিল ঘনবরণ। অসম্ভব চালাক কবি কৃষ্ণধন। কোন গাছে উঠতে কোন মই দরকার, খুব দ্রুত সেই সিদ্ধান্তে আসতে পারে। তারপর তরতর করে ফলন্ত ডালে পৌঁছে ফলটি পেড়ে নিতে দেরি হয় না তার। আর পোদ্দার যদি ডাক পায়, তবে সে কেমন ডিজাইনের, কী রঙের পাঞ্জাবি এবং লোয়ার হিসেবে কী পরবে– সেটাও জানা খুবই জরুরি ব্যাপার।

বঙ্গ সারস্বত সমাজে এই দুই কবির লড়াই সবাই বেশ উপভোগ করে। উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন মইয়ের কাছে একান্ত দরবারে এ ওর নামে কী কী নালিশ জানায়, সেটা কোনও এক আশ্চর্য উপায়ে প্রকাশ পেয়ে যায়। সবাই হাসাহাসি করে। কিন্তু ওদের কাব্যপ্রতিভা বিকাশের জন্য যে উদ্যম, এই হাসাহাসিতে তাতে কোনও ব্যাঘাত ঘটে বলে মনে হয় না। ইদানীং ঘনবরণ ১-০ তে পিছিয়ে আছে। গত মাসে শকুনমারির চরে বিশ্ব কবিতা উৎসবে কৃষ্ণধন পোদ্দার ডাক পেল, কিন্তু ঘনবরণ পেল না– এখানে কোন গোপন সমীকরণ কাজ করেছে, সেটা সে কিছুতেই সমাধান করতে পারছে না। যেখানে যা দেবার থোবার, বিধিসম্মত ভেবে সবই সে করেছে। এখন প্রশ্ন হল এমন কী কাজ কালোমানিক করেছে, যা সে করতে পারেনি।

মেজাজ খারাপ থাকলে সে কৃষ্ণধনকে বিভিন্ন নামে ডেকে থাকে। এতে দেখা গিয়েছে চড়া বায়ু স্নিগ্ধ হয়। কুপিত পিত্ত শীতল হয়। কফের কালারও সবজেটে থেকে কিছুটা নর্মাল হয়ে আসে। শ্বশুরমশাই ছিলেন বিক্রমপুরের বিখ্যাত কবিরাজ। এই তিনটি জিনিসের ওপর চিরকাল জোর দিয়ে এসেছেন। কিন্তু এবার ঘনবরণের মাথা কিছুতেই ঠান্ডা হচ্ছে না। মনটা বড় কু গাইছে। এবারও যদি সে মঞ্চে উঠে কবিতা পড়তে না পারে, আর কৃষ্ণধন যদি ডাক পায়, তবে কবিতা লেখা বৃথা। বাংলাবাজারে তার মানমর্যাদা কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। এমনিতে জনান্তিকে সে কৃষ্ণধনকে বিভিন্ন নামে ডেকে থাকে। কালোমানিক, ব্ল্যাকমানি। এ ছাড়াও ‘কৃষ্ণধন পোদ্দার’ এই নামকে বিকৃত করে অনেক সময় অশ্লীলতার পর্যায়েও নিয়ে যায়। তখন মনটা একটু শান্ত হয়।

তার কানে এসেছে তার নাম নিয়েও নাকি কৃষ্ণধন নানা কথা বাজারে চাউর করেছে। তার শরীরের ঘন বরণের জন্যই নাকি অন্ধকার রাস্তায় লোকজন তার সঙ্গে ধাক্কা খায়। বডিশেমিং-এর আওতায় এনে কোনও ধারায় কেস করা যায় কি না, সেটা নিয়ে বিশ্বস্ত কারও সঙ্গে একটু আলাপ করা দরকার। মা ছোটবেলায় আদর করে ডাকত ‘ঘনু’, বলত ঘনু হল উজ্জ্বল শ্যাম। আসলে তার মতো রয়্যালটি পাচ্ছে না বলেই ওসব কথা রটায়। এখন কথা হচ্ছে শকুনমারির চরে বিশ্ব কবিতা উৎসবে কৃষ্ণধন কী করে সুযোগ পেল। কোন মই সে ধরেছিল।

এসব কারণে তার মেজাজটা ছানাকাটা দুধের মতো ছিঁড়ে গিয়েছিল। তার আবার রাতে ভাতের পাতে কিছু ভাজাভুজি না থাকলে সব বিস্বাদ লাগে। আজ সে দেখল ডাল, ভাত আর শিঙি মাছের ঝোল। এমনকি পটল ভাজাও নেই। মাথা গরম হয়ে গিয়েছে। ইচ্ছে ছিল আজ রাত জেগে অসমাপ্ত দীর্ঘ কবিতা ‘বেগুনি বাতাসের হাহাকার’ লেখাটা শেষ করার। এই তিরিক্ষি মেজাজ নিয়ে সম্ভব নয়।

‘কী ব্যাপার, ডালের সঙ্গে কিছু ভাজা নেই?’

‘ভাজা বন্ধ। খবরের কাগজ পড়লে কি কবিদের মান থাকে না? দেখছ না রোজ পেপারে লিখছে তেলের দাম বাড়বে। কোথায় নাকি যুদ্ধ লেগেছে। হ্যাঁ গো, তরমুজও নাকি বন্ধ করে দেবে। তেল এখন থেকে একটু চেপে খরচ করতে হবে।’

খবরের কাগজ একটা রাখা হয় বটে, কিন্তু ঘনবরণ সেখানে সাহিত্য-সংস্কৃতির পাতা ছাড়া অন্য কোনও খবরে উৎসাহ পায় না। তবে মনে পড়ল পেপারে তেলের কথা কী যেন ছিল। মন দিয়ে পড়া হয়নি। পড়া উচিত ছিল। আজকালকার সমাজে তেল অতি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। তেল ছাড়া জগত অচল। যখনই মনে হবে চাকা ঘুরতে চাইছে না, ঠিক জায়গায় একফোঁটা দিলেই কাজ হাসিল। এটা একটা শিল্পও বটে। ঠিক সময়ে ঠিক জায়গায় তেল দিতে পারা সহজ কর্ম নয়। ভুল জায়গায় ভুল সময়ে তেল দিয়ে অনেকের পাকা ঘুঁটি কেঁচে গিয়েছে। এই কলায় রপ্ত হতে পারলে সব মুশকিল আসান হয়ে যায়। তেলের দাম বাড়তে পারে শুনে তার ভ্রূযুগল কুঞ্চিত হয়ে গেল। তবে সরকার নিশ্চয় একটা বিকল্প ব্যবস্থা করবে। তেল ছাড়া চাকাই ঘুরবে না। মানুষের সভ্যতার অগ্রগতি তেল ছাড়া অচল। তেল দিতে না পারলে বিল্ডিং তৈরি হবে না, ব্রিজ তৈরি হবে না, চাকরি হবে না, প্রোমোশন হবে না, পুরস্কার জুটবে না, বিদেশযাত্রা হবে না, কবিসভায় ডাক পড়বে না। এই মসৃণ পিচ্ছিলকারক পদার্থ সর্বক্ষেত্রে মানুষকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছে দেয়।

‘তুমি ঠিক জানো তেল পাওয়া যাবে না? তবে তো ভারী মুশকিল।’

‘ক’টা দিন তেলেভাজা জিনিস একটু বন্ধ রাখো। আবার সব ঠিক হয়ে যাবে। কম তেলে খাওয়া রপ্ত করো এবার।’

‘আচ্ছা, তা হলে তো কালোমানিকেরও মুশকিল। আসলে কি জানো, মইও একটা কল। খুব তেল খায়। তুমি কি জানো ভ্যারেন্ডার তেলে কাজ হয় কি না? একদিন দেখো তো ভ্যারেন্ডার তেলে ভ্যারেন্ডা ভাজা যায় কি না। নতুন পাঞ্জাবিটা বোধহয় আর পরাই হবে না এবার।  আর, তরমুজের কথা কী বলছিলে?’

‘পেপারে তো দেখেছিলাম, যুদ্ধের জন্য নাকি তরমুজ বন্ধ হয়ে যাবে। জাহাজ চলাচল না করলে বিদেশি তরমুজ কীভাবে আসবে।’

‘হ্যাঁ, আমিও দেখেছি। তরমুজ নয়, ওটা হরমুজ প্রণালী। আজকাল তো নতুন টাইপের তরমুজ বাজারে এসে গিয়েছে। ওপরে সবুজ, ভেতরে গেরুয়া। খেতে ইচ্ছে হলে বোলো, এনে দেব। বাজারে দেদার বিকোচ্ছে।’



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *